কাপ যুদ্ধ
রুশ বিপ্লবের স্বপ্নভঙ্গ
রাশিয়ায় কত মানুষের স্বপ্ন বাজেয়াপ্ত হলো! কত নক্ষত্রের পতন হলো! রাশিয়া থেকে অনেক অনেক দূরে বসেও কত মানুষ চোখের জলে ভাসল। কারণ, তাদের প্রিয় দল বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেছে! বিশ্বকাপ নিয়ে রাশিয়ায় ফুটবল বিশ্বের কত রঙের টুকরো টুকরো খণ্ড ছবি! যা জোড়া লাগালে হয়ে যায় বিশাল এক ক্যাভাস। যেখানে ফুটে উঠেছে আনন্দ-উল্লাস, হতাশা-বিষাদের কত রং! এটাই আসলে ফুটবল। আর এই ফুটবল ঘিরে রুশরাও নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। নাটক, নাটক এবং সত্যিই চরম নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে তাদের কাপ জয়ের সেই স্বপ্নে ছেদ পড়ে গেল। ক্রোয়েশিয়ার কাছে টাইব্রেকারে হেরে শেষ দল হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নিল রাশিয়া।
সমাজতন্ত্রের ঘরানা থেকে বেরিয়ে আসা দুটি দেশের ফুটবল দল বিশ্বকাপের শেষ কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল। ক্রোয়াটদের বিপক্ষে ম্যাচের আগে রুশ গ্যালারিজুড়ে একটা বিশাল ব্যানার ছিল। যাতে লেখা ছিল, ‘তোমাদের সুযোগ। আমাদের স্বপ্ন। তোমরা না পারলে কারা পারবে?’ ম্যাচে প্রথম গোল করে সেই স্বপ্ন পূরণের কাছাকাছি পৌঁছেও যায় রুশরা। কিন্তু ফিরতে বেশি সময় নেয়নি ক্রোয়াটরা। শুধু সমতা আনল না। এগিয়েও গেল তারা। নব্বই মিনিটের সেই লড়াই শেষ হলো আবার সমতায়! শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকার নামক ভাগ্য পরীক্ষা। আর তাতেই ধাক্কা খেয়ে ছিটকে গেল রাশিয়া।
রুশদের আগে সুইডিশরাও বিদায় নিয়েছে। ইংলিশদের দাপটে কোমর সোজা করেই দাঁড়াতে পারেনি সুইডিশরা। হ্যারি কেনের আলোয় সত্যিই ইংলিশরা কাপটাকে আরো একটু কাছ থেকে দেখতে শুরু করেছে। তারা ভাবতেও শুরু করছে, ‘ফুটবল বাড়ি ফিরবে’! ২৮ বছর পর সেমিফাইনালে ইংল্যান্ড। ফুটবলকে বাড়ি ফেরাতে তাদের দরকার আর তো মাত্র দুটো জয়। সেই দুটো ম্যাচ জিততে পারলে সত্যিই বিশ্বকাপ ইংল্যান্ডে চলে যাবে। কিন্তু সাউথগেটের দলের জন্য সেমিফাইনাল আর ফাইনালের গেট পেরিয়ে যাওয়া খুব সহজ হবে কি! সেমিফাইনালেই তাদের প্রতিপক্ষ ক্রোয়েশিয়া। উত্থান-পতনের ভেলায় ভেসে শেষ চারে তারা। সাউথগেটের ইংল্যান্ড দলের ডিফেন্সে স্লুইসগেট খুঁজে নেওয়ার মতো ফরোয়ার্ড এই ক্রোয়েশিয়া দলে আছেন।
ইংল্যান্ডের মতো শিরোপা পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন নিয়ে এখনো রাশিয়ায় ভালোভাবে টিকে আছে ফ্রান্স। ফরাসিদের কাপ পুনরুদ্ধারের স্বপ্নের বয়স এখন বিশ। আর ইংলিশদের অপেক্ষা ৫২ বছরের। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স দুটো দলই চাইছে অপেক্ষার পালা ঘোচাতে। আরো যে দুটো দল টিকে আছে কাপ জয়ের স্বপ্ন বুকে নিয়ে, তারা চাইছে নয়া ইতিহাস লিখতে। বেলজিয়াম পাচ্ছে সেই ইতিহাসের অন্যতম চিত্রনাট্যকার হিসেবে আবার একজন ফরাসিকে। কাপ জয়ের ইতিহাস জানা আছে যার। আপাতত তাঁর পরিচয় বেলজিয়াম দলের সহকারী কোচ। আর তিনি দেশমের কাপজয়ী সেই দলের তারকা ফরোয়ার্ড। তা ছাড়া এই বেলজিয়াম দলটা খেলছে দুর্দান্ত। একঝাঁক প্রতিভাবান ফুটবলার তাদের দলে। যারা গতি আর স্কিল দিয়ে ব্রাজিলকেও বিদায় করে দিয়েছে। ওরা ফর্মে থাকলে সেদিন মাঠে ফুলের মতো পাপড়ি মেলছে বেলজিয়ানদের ফুটবলটা। এনজো শিপোর দেশ ’৮৬-এর পর আর বিশ্বকাপের সেমিফাইলে উঠতে পারেনি। এবার তারা বাকি বিশ্বকে দেখাতে চায়, তারা উঠে আসছে। তবে দুর্দান্ত ছন্দে ফ্রান্স। মাঠে ফরাসি সৌরভ ছড়াছে দেশমের দলের গ্রিজম্যান, এমবাপে, ডেমবেলের মতো তরুণরা।
আফ্রিকান কোনো দেশ রাশিয়ায় নকআউটে আসতে পারেনি। এশিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে নকআউটে টিকে ছিল জাপান, যারা চোখের জলে রাশিয়া থেকে বিদায় নিল। কিন্তু এক দর্শনের জন্ম দিয়ে গেল, ফুটবল মাঠ যেমন যুদ্ধক্ষেত্র, আবার তেমনি ফুটবল মাঠ শিল্পের বিশাল ক্যানভাস। জাপান যুদ্ধ জয়ের হাসি নিয়ে রাশিয়া থেকে বিদায় নিতে পারেনি। দুর্দান্ত কোনো শিল্পকর্মও রেখে যায়নি বিশ্বকাপ ক্যানভাসে। তবে বিশ্বকাপ ইতিহাসে স্বতন্ত্র এক সরণি বেয়ে হেঁটে গেল তারা। যার নাম ‘সৎ সরণি’! পরিচ্ছন্ন ফুটবল খেলে গেল জাপানিরা। শেষ ম্যাচে পোল্যান্ডের কাছে হেরেও ফেয়ার প্লের সৌজন্যে শেষ ষোলোতে এসেছিল জাপানিরা। বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিবৃত্তে সেও এক নতুন অধ্যয়। লাতিনদের ফুটবলীয় আবেগ-ভালোবাসা সবকিছু খারিজ হয়ে গেছে পুতিনের দেশে।
তাই রাশিয়া বিশ্বকাপের চার সেমিফাইনালিস্টই ইউরোপিয়ান। কাপটা ইউরোপেই থাকছে। শিশু পাঠ্য মুখস্থ করতে থাকা বাচ্চাটাও তা জেনে গেছে। কিন্তু রাশিয়ায় ১৫ জুলাইয়ের শেষ লড়াইটা কী হবে? কাপ পুনরুদ্ধারের, নাকি কাপ জয়ের নতুন ইতিহাস লেখার? যাই হোক, ফাইনাল যখন হবে অল ইউরোপিয়ান, সেখানে ফুটবলে শিল্পের সৌন্দর্য আর নান্দনিকতা খুঁজতে গিয়ে কার্যকরিতাকে বিসর্জন দেওয়ার বিলাসিতা দেখাবে না কেউ।
আর বাঙালির শিল্পিত ফুটবল দেখার স্বপ্ন সেটা তো খারিজ হয়েই গেছে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-উরুগুয়ের মতো লাতিন দেশগুলোর বিদায়ে।
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।