ক্যারেন আর্মস্ট্রং
ফিরিয়ে আনি সেই ‘স্বর্ণালি বিধি’
(২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক একটি সম্মেলনে দেওয়া বক্তৃতায় ধর্মীয় ইতিহাসবিদ ক্যারেন আর্মস্ট্রং নজর দিয়েছেন একবিংশ শতাব্দীতে ধর্মের ভূমিকার দিকে। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ধর্মের গোঁড়া মতবাদগুলো কি আমাদের আরো বিচ্ছিন্ন করবে? নাকি সবার মঙ্গলার্থে এটা আমাদের একত্রিত করবে? তারপর তিনি সেই প্রভাবকগুলো পর্যালোচনা করেছেন যা পুরো বিশ্বের ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোকে তাড়িত করতে পারে, ‘স্বর্ণালি বিধি’ পুনরুদ্ধার করতে। টেকনোলজি এন্টারটেইনমেন্ট ডিজাইন (TED) আয়োজিত অনুষ্ঠানে দেওয়া এই বক্তৃতাটি বাংলায় ভাষান্তর করেছেন পার্থ প্রতীম দাস।)
বিশ্বের সব প্রধান ধর্মীয় বিশ্বাসের কেন্দ্রে রয়েছে সমবেদনার ধারণা। আর একজন ধর্মীয় ইতিহাসবিদ হিসেবে আমি এ সম্পর্কে তীব্রভাবে সচেতন হয়ে উঠেছি। প্রতিটি ধর্মই এই ধারণাকে তাদের নিজেদের মতো করে গড়ে তুলেছে, যেটাকে বলা যেতে পারে ‘স্বর্ণালি বিধি’। কখনো এটা আসে ইতিবাচক রূপে — ‘অন্যদের সঙ্গে এমন আচরণ কর, যেমনটা তুমি নিজের ক্ষেত্রে প্রত্যাশা কর।’ আর এটার নেতিবাচক রূপটাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ — ‘কারো সঙ্গে এমন কিছু করো না যেটা তুমি চাও না যে, কেউ তোমার সঙ্গে করুক।’ নিজেকে জিজ্ঞেস করে খুঁজে বের করো যে, কোন জিনিসগুলো তোমাকে যন্ত্রণা দেয় আর তারপর কোন পরিস্থিতিতেই সেই জিনিসগুলো করো না যা অন্যদের জন্যও যন্ত্রণা বয়ে আনবে।
আর মানুষ সব সময়ই সমবেদনার এই ধারণার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছে। শুধু এ কারণে না যে, এটা শুনতে ভালো লাগে। কারণ এটা সত্যিই কাজে লাগে। মানুষ দেখেছে যে, যখন তারা এই স্বর্ণালি বিধির প্রয়োগ ঘটায়, যেমনটা কনফুসিয়াস বলেছেন, ‘প্রতিদিন ও প্রতিটা সময়’, ব্যাপারটা এ রকম না যে আপনি শুধু একটা নির্দিষ্ট সময়ে এটা করলেন আর তারপর ফিরে গেলেন লোভসর্বস্ব-আত্মকেন্দ্রিক জীবনে। বরং এই স্বর্ণালি বিধির প্রয়োগ যদি প্রতিটা সময়ই করা যায়, তাহলে আপনি আপনার দুনিয়ার কেন্দ্র থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারবেন। আপনি নিজের সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারবেন। আর এটাই আপনাকে নিয়ে আসবে, যাকে আমরা ডাকি ঈশ্বর-নির্বাণ-রাম-তাও প্রভৃতি নামে, তার সান্নিধ্যে। এটা এমন এক অভিজ্ঞতা, যেটা আমাদের আত্মকেন্দ্রিক অস্তিত্বের সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায়।
কিন্তু এই ব্যাপারটা যে আপনার ধর্মীয় জীবনের সঙ্গে এতটা গভীরভাবে সম্পর্কিত এটা আপনি বেশিরভাগ সময়ই জানতে পারেন না। কারণ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, বেশিরভাগ সময় যখন ধর্মীয় মানুষরা, ধর্মীয় নেতারা একত্রিত হন, তখন তারা ধর্মের দুর্বোধ্য সব মতবাদ নিয়ে আলোচনা, অন্য ধর্মের প্রতি বিষোদাগার, সমকামিতা বা এই ধরনের জিনিসপত্রের বিরোধিতা করে সময় কাটায়। বেশিরভাগ সময়ই মানুষ সত্যিই সমবেদনশীল হতে চায় না। আমি এ ধরনের ধর্মীয় মানুষদের সমাবেশে কথা বলার সময় মাঝেমধ্যে তাদের মুখে এক ধরনের বিদ্রোহী অভিব্যক্তি দেখেছি। কারণ মানুষ সব সময়ই নিজেকে সঠিক বলে দাবি করতে চায়।
আমি এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলার একটা তাগিদ অনুভব করেছি। আমরা যদি স্বর্ণালি বিধিটা বৈশ্বিকভাবে প্রয়োগ করার সুযোগ না পাই, আমরা যদি সব মানুষকেই (সে যেই হোক না কেন) আমাদের নিজেদের মতোই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করতে না পারি, তাহলে আমার সন্দেহ হয় যে, আমরা আদৌ আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে একটা ক্রমবিকাশমান দুনিয়া রেখে যেতে পারব কি না।
আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় কাজটা হচ্ছে, এমন একটা বৈশ্বিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে সব মানুষ একসঙ্গে শান্তিতে থাকতে পারবে। আর এই কাজে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর যেখানে একটা বড় অবদান রাখার কথা, সেখানে তারা আবির্ভূত হচ্ছে একটা সমস্যা হিসেবে। আর অবশ্যই স্বর্ণালি বিধিতে যারা বিশ্বাস করে তারা শুধুই ধর্মীয় মানুষ নয়। সহানুভূতির এই মনোকল্পিত কর্মকাণ্ডটাই হচ্ছে সব নৈতিকতার উৎস। নিজের জায়গায় অন্য একজনকে স্থাপন করা।
আর তাই আমার মনে হয়, আমাদের কাছে সুযোগ আছে বেছে নেওয়ার। একদিকে আমরা আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের গোঁড়া ও অসহিষ্ণু দিকগুলোর দিকেই ঝুঁকে পড়তে পারি বা ফিরে যেতে পারি সেই রাবাইয়ের কাছে। রাবাই হিল্লেল, যীশু খ্রিস্টের সমসাময়িক এক ইহুদি নেতা। প্যাগান ধর্মাবলম্বীরা তাঁকে এক পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে পুরো ইহুদি ধর্মের সারাংশ বলতে বলেছিল। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘যেটা তোমার কাছে ঘৃণিত, এমন কোনো কাজ প্রতিবেশীদের সঙ্গে কর না। এইটাই তোরাহ। বাকি সবকিছু এর বিস্তারিত বর্ণনা।’
আর এই রাবাই ও চার্চের প্রথমদিকের মানুষরা বলেছিল যে, ধর্মগ্রন্থের ঘৃণা ও বিদ্বেষ উৎপাদনকারী কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া অনৈতিক। আমাদের এই চেতনাটাই পুনরুদ্ধার করতে হবে। আর এটা এমনি এমনিই হয়ে যাবে না। আমাদেরই এটা বাস্তবায়ন করতে হবে। আর TED যে ধরনের আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে তা দিয়ে আমরা এটা করতেও সক্ষম হব। ইতিমধ্যেই আমি আমাদের সহযোগীদের কাছ থেকে প্রচণ্ড উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া পেয়েছি।
সিঙ্গাপুরে, আমরা এমন একদল মানুষকে পেয়েছি যারা এই সমবেদনার সনদটি নিয়ে কাজ করছে, তাদের সমাজে উদ্ভুত নানা বিভাজন মোকাবিলা করতে। আর সংসদেরও কিছু সদস্য এটাকে প্রয়োগ করতে চেয়েছেন রাজনৈতিকভাবে। মালয়েশিয়ায়, একটা শিল্প প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যেখানে প্রধান সারির শিল্পীরা অনেক মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন আর তাদের দেখাবেন যে, সব ধরনের শিল্পের গোড়াতেও আছে সমবেদনার ধারণা। আর ইউরোপজুড়ে, মুসলিম সম্প্রদায় নানা ধরনের অনুষ্ঠান, আলোচনা সভার আয়োজন করছে, যেখানে তারা বলছে যে ইসলামসহ সব ধরনের ধর্মীয় বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে এই সমবেদনার ধারণা।
কিন্তু এটা এখানেই থেমে যেতে পারে না। শুরু করার উদ্যোগ নিয়েই এটা শেষ হতে পারে না। বিমূর্ত সব মতবাদে বিশ্বাস স্থাপনের ওপর সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে আমরা ধর্মীয় শিক্ষার বিষয়টিতে খুবই ভুল করে এসেছি। ধর্মীয় শিক্ষা অবশ্যই কর্মতৎপরতার দিকেও নিয়ে যেতে হবে। আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এটা নিয়ে কাজ করে যাব। আর আমি আমার সঙ্গীদের দুটি দিক নিয়ে কাজ করতে বলব— সমবেদনার ধারণাটি সম্পর্কে মানুষকে জানানো ও তাদের মধ্যে উদ্দীপনা তৈরি করা। জানানোর বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বর্তমানে করুণা বা সমবেদনার ধারণা আমাদের ভিতর থেকে ঝড়ে পড়েছে। মানুষ প্রায়ই এমনটা ভাবে যে, কারো জন্য দুঃখ বোধ করাটাই সমবেদনা প্রকাশের স্বরূপ। কিন্তু এইভাবে চিন্তা করলে বলা যায় অবশ্যই আপনি সমবেদনার ধারণাটা বুঝতে পারেননি। শুধু চিন্তা করলেই হবে না, কাজেও আপনার চিন্তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
আমি এই কাজে গণমাধ্যমকে সংযুক্ত করতে চাই। কারণ গণমাধ্যম সমাজে প্রতিষ্ঠিত গৎবাধা দৃষ্টিভঙ্গি (যেগুলো মানুষকে একে অপরের থেকে বিভক্ত করে রাখে) পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অনেক সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। সামাজিক শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমি তরুণদের প্রতিও এই সক্রিয়তার স্বাদ নেওয়ার, সমবেদনাপূর্ণ জীবনধারায় জীবনযাপন করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণের আহ্বান জানাব। আর এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে, এই জীবনধারা দাবি করে সংবেদনশীল ও সূক্ষ বুদ্ধিমত্তা, শুধুই কিছু ভাবপ্রবণ আবেগই যথেষ্ট নয়।
বিভিন্ন এলাকার মানুষের সংস্কৃতিতে এই সমবেদনা সংশ্লিষ্ট বিষয়বস্তু কিভাবে ছড়িয়ে আছে তা খুঁজে বের করার জন্য আমি স্কলারদের প্রতি আহ্বান জানাব। আর সম্ভবত সবকিছুর ওপরে, স্কলারদের কাজ করতে হবে বিদ্বেষপূর্ণ ধর্মীয় ধারাভাষ্যের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করার জন্য। যেন যখনই কেউ মনে করবে যে, ধর্মীয় বা রাজনৈতিক নেতারা বিদ্বেষ বা ঘৃণাপূর্ণ বক্তব্য দিচ্ছে, তখনই যেন মানুষ সেটাকে রুখে দেওয়ার মতো সামর্থ্যবান হয়ে ওঠে। কারণ আমরাই এই দুনিয়াটা বদলাতে পারি। আমাদের সেই সক্ষমতা আছে।
ব্রিটেনের এক লেখক, সি.এস লুইসকে উদ্ধৃত করে আমি শেষ করতে চাই। স্কুলে পড়ার সময় তাঁর একটা লেখা আমার মাথায় গেঁথে গেছে। ‘দ্য ফোর লাভস’ বইয়ে তিনি বলেছেন ঘনিষ্ঠ প্রেম সম্পর্কের কথা, যখন দুটি মানুষ একে অপরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আর তারপর তিনি এই সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করেছেন বন্ধুত্বের। যেখানে দুটি মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাশাপাশি দাঁড়ায়, তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে একটা সাধারণ লক্ষ্যের দিকে।
আমাদের একে অপরের প্রেমে না পড়লেও চলবে। কিন্তু আমরা তো বন্ধু হতে পারি। আর আমি এই ধারণার সঙ্গে একমত। আমি এটা খুবই গভীরভাবে টের পেয়েছি যে, যখন বিভিন্ন চিন্তাধারার মানুষ একটা সাধারণ লক্ষ্যে কাজ করার জন্য একত্রিত হয় এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে তখন তাদের ভিন্নতাগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আর তখন আমরা শিখি বন্ধুত্ব। আর আমরা শিখি যে, কিভাবে একত্রে বাস করতে হয়, কিভাবে একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে হয়। অনেক ধন্যবাদ।