মানিকগঞ্জে শুরু হয়েছে নিমাই চাঁদের মেলা
ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে মানিকগঞ্জের বালিরটেকে কালীগঙ্গা নদীতে শুরু হয়েছে প্রায় ৭০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী নিমাই চাঁদের পুণ্যস্নান উৎসব। প্রতিবছরের মতো এবারও মানিকগঞ্জ, শিবালয়, নবাবগঞ্জ, হরিরামপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কয়েক হাজার পুণ্যার্থী এই স্নান উৎসবে অংশ নিয়েছে। এই উপলক্ষে বসেছে ১৫ দিনব্যাপী নিমাই চাঁদের মেলা।পঞ্জিকা অনুযায়ী গত বুধবার রাত ১০টার দিকে এই উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে।
নিমাই চাঁদ বিগ্রহ মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক অতুল কুমার বালো জানান, তীর্থযাত্রীরা পুণ্যলাভের আশায় স্নান করতে গতকাল ভোর থেকে সমবেত হতে থাকেন বালিরটেক বাজারসংলগ্ন কালীগঙ্গা নদীর তীরে। পুণ্যার্থীরা নদীতে ঘুরে ঘুরে পুণ্যস্নানে অংশ নেন। নিমাই চাঁদের প্রতিকৃতির নিচ দিয়ে পুণ্যস্নানে অংশ নেন পুণ্যার্থীরা। দূর-দূরান্ত থেকে আসা আত্মীয়-অনাত্মীয়ের পদভারে মুখর হয় এলাকার প্রতিটি বাড়ি। পুণ্যস্নানে অংশ নেওয়া পুণ্যার্থীদের জন্য বালিরটেক হরিসভা বাজার কমিটির আয়োজনে ভক্তসেবার আয়োজন করা হয়। ১৫ দিনের মেলায় বিভিন্ন রকমের দোকান, পুতুল নাচ ও সার্কাস বসেছে।
স্থানীয় সনাতনী পুরাণ ও বিশ্বাস মতে, প্রায় ৭০০ বছর আগে থেকে নিমাই চাঁদের পূজা হয়ে আসছে। পদ্মা নদীর ওপারে ফরিদপুর স্থানে জনৈক কাঠমিস্ত্রি তাঁর বাড়িতে একটি নিমগাছ লাগিয়েছিলেন। প্রতিদিন তিনি নিমগাছের নিচে পরিষ্কার করে রাখতেন। গাছ যখন বড় হয়, তখন একদিন ওই গাছের ভেতর থেকে দৈববাণী শুনতে পান মিস্ত্রি। গাছের কাণ্ডের অংশ দিয়ে মূর্তির মতো করে নিমাই চাঁদ নামক কাঠের দেবতা তৈরি করার আদেশ পান তিনি। তখন মিস্ত্রি দৈববাণী মোতাবেক কাঠের দেবতা তৈরি করেন। নিয়মিত পূজা করতে থাকেন। একদিন মিস্ত্রির বাড়িতে আগুন লাগে। তখন মিস্ত্রি রাগান্বিত হয়ে বলেন, ‘আমি তোর পূজা করি। আমার বাড়িতে আগুন লাগল কী করে।’ তখনই কাঠের দেবতাকে তিনি আড়াইল বিলে ফেলে দেন।
বিলের তীরে বাস করতেন এক নারী। তিনি দেখতে যেমন সুশ্রী তেমনি ধর্মপ্রাণ ছিলেন। তিনি বিল থেকে নিয়মিত জল আনতেন। একদিন তিনিও দৈববাণী শুনতে পেলেন। প্রথমে তিনি কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না। পরের দিন আবার দৈববাণী শুনতে পেলেন, ‘তুই আমাকে জল থেকে তুলে নে।’ তখন তিনি বিল থেকে কাঠের দেবতাকে তুলে নিয়ে গেলেন বাড়িতে। নিয়মিত দেবতার পূজা করতে থাকলেন। স্বপ্নে আদেশ পেলেন, তিনি যেন আরো বড় করে নিমাই চাঁদের পূজা দেন। সেই থেকে ওই নারী বাংলা সনের চৈত্র মাসের ২০তম দিনে স্নান শুরু করেন। কথিত আছে, মূর্তিকে স্নান করানো হতো রাতে। সেই সময় এক শ্রেণির অসাধু মানুষ তাঁকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করত।
পরে ব্রিটিশ আমলের জমিদাররা ওই দেবতার নামে জমি দান করেন। ওই জমির ওপর মন্দির ও মেলার স্থান নির্ধারণ হয়। মন্দিরের তৎকালীন চেয়ারম্যান প্রেমচরণ মহাত্মা, লোকনাথ বালো ও কাঙ্গাল গোসাই নিয়ম করেন- বৈশাখের ২ তারিখে নিমাই চাঁদের স্নান হবে। সেই থেকে পর্যায়ক্রমে তুলশি বালো, আদ্যনাথ বালো, পদ্মচরণ বালো, কৃষ্ণকুমার বালো, মাখন চন্দ্র রায়, ভজন বালো, রসিক লাল বালো, ভোলানাথ রায় একইভাবে পূজা করে আসছেন। তখন থেকেই শুরু হয়েছে নিমাই চাঁদের মেলা এবং কালীগঙ্গা নদীতে নিমাই চাঁদের পুণ্যস্নান।