ঘুরে আসুন জাতীয় জাদুঘর
আজ ১৮ মে, বিশ্ব জাদুঘর দিবস। ঢাকার শাহবাগে অবস্থিত বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর থেকে যেকোনো সময় চাইলেই ঘুরে আসতে পারেন। সঙ্গে নিতে পারেন বাচ্চাদের, যাতে তারাও বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারে।
১৯১৩ সালের ৭ আগস্ট ‘ঢাকা জাদুঘর’ নামে যাত্রা শুরু করেছিল জাতীয় জাদুঘর। তৎকালীন বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল ঢাকা মেডিকেল কলেজের একটি কক্ষে এর উদ্বোধন করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৮৩ সালে একে ‘বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর’ নামে অভিহিত করা হয়।
চারতলা এই ভবনের স্থাপত্য নকশা অত্যন্ত নজরকাড়া। ২০ হাজার বর্গমিটারের এই ভবনটির ৪৬টি গ্যালারিতে রয়েছে প্রায় ৮৩ হাজারের বেশি নিদর্শন। কেবল বাংলাদেশেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এটি সর্ববৃহৎ জাদুঘর। নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশের ইতিহাস ও সভ্যতার প্রতিটি ধাপের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া এই প্রতিষ্ঠান বর্তমানে রয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে।
টিকেট কেটে মূল ফটক পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেই দেখা মিলবে জাদুঘর ভবনের। ভবনটির চারদিকে রয়েছে প্রচুর গাছপালা, যা এক মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। ভবনের প্রবেশদ্বারে রয়েছে সুসজ্জিত দুটি কামান। ভবনটির ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে নান্দনিক নভেরা ভাস্কর্য। নিচতলায় রয়েছে শুভেচ্ছা স্মারক বিপণি, সে সঙ্গে রয়েছে ব্যাগ রাখার স্থান ও কয়েকটি খাবারের দোকান। সিঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে উঠলেই পাবেন গ্যালারি নির্দেশক। প্রতিটি তলাতেই রয়েছে এই নির্দেশক, যা দর্শনার্থীকে প্রতিটি তলার গ্যালারি সম্পর্কে অবগত করে।
জাদুঘরের প্রথম তলাটি যেন পুরো বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ। বাংলাদেশের মানচিত্র দিয়ে শুরু হওয়া এই তলাতে আরো দেখতে পাবেন বাংলাদেশের গাছপালা, প্রাণী, সুন্দরবন, উপজাতীদের জীবনধারা, খনিজ শিলা, ভাস্কর্য, মুদ্রা এবং প্রাচীন যুগের নানাবিধ ভাস্কর্যের।
ভবনটির দ্বিতীয় তলায় দেখতে পাবেন বাংলাদেশের সভ্যতা ও ইতিহাসের ক্রমবিবর্তন। বিভিন্ন সময়ের অস্ত্র, বাদ্যযন্ত্র, চীনামাটির হস্তশিল্প, কুটিরশিল্প, পাণ্ডুলিপি, সমকালীন শিল্পকলা এবং বাংলাদেশের নানাবিধ ঐতিহ্য দিয়ে সাজানো হয়েছে এই তলা।
ভবনের তৃতীয় তলায় রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন স্বনামধন্য ব্যক্তির প্রতিকৃতি, চিত্রকর্ম ও বিশ্বসভ্যতার নানা নিদর্শন।
বাংলাদেশ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য শিক্ষাভ্রমণের এক উপযুক্ত স্থান হতে পারে বাংলাদেশ জাদুঘর। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা দলবেঁধে প্রায়ই আসেন এখানে। তেমনি একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মাহফুজ সালেকীন বর্ষণ। তিনি জানালেন, পাঠ্যপুস্তকে পড়া বাংলাদেশের ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো সামনাসামনি দেখার এ যেন এক বিরাট সুযোগ। বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞানলাভের জন্য প্রত্যেক শিক্ষার্থীরই জাদুঘরে আসা উচিত বলে তিনি মনে করেন। কেবল শিক্ষার্থীরাই নয়, নানা বয়সের মানুষের আগমন ঘটে এখানে। ছোট ছোট বাচ্চাকে মা-বাবার হাত ধরে যেমন ঘুরতে দেখা যায় এখানে, তেমনি দেখা যায় প্রবীণ গবেষকদের। সব বয়সের মানুষের চাহিদা পূরণ করে আসছে এই জাদুঘর।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় কিছু গ্যালারির কাজ চলছে দেখা যায়। সে সম্পর্কে জাদুঘরের কর্মচারী ষাটোর্ধ্ব ইব্রাহিম মিয়া জানান, পুতুল নামে একটি নতুন গ্যালারির এবং বাদ্যযন্ত্র ও নকশিকাঁথার দ্বিতীয় গ্যালারি সংযুক্তির কাজ চলছে।
প্রতিদিন দর্শনার্থীর সংখ্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে ইব্রাহিম মিয়া বলেন, প্রতিদিন প্রায় দুইশ থেকে আড়াইশর মতো মানুষ আসে এখানে, দুপুরের পর থেকে দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়তে থেকে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে অন্যান্য দিনের চেয়ে লোকসমাগম বেশি হয় এখানে। কেবল বাংলাদেশিরাই নন, বিভিন্ন দেশের নাগরিকরাও আসেন জাদুঘর ভ্রমণে।
বাংলাদেশ নিয়ে গবেষণার কাজে আসা ব্রিটিশ নাগরিক ক্যালভিন ডোনাল্ডের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, কেবল দুদিনের সফরে বাংলাদেশে আগমন তাঁর। এত অল্পসময়ে পুরো বাংলাদেশ ভ্রমণ সম্ভব নয় বিধায় তাঁরই এক বাংলাদেশি বন্ধুর পরামর্শে জাদুঘর দর্শনে আসেন তিনি। বন্ধুর উপদেশ একেবারেই বিফলে যায়নি বলে মনে করেন তিনি। সে সঙ্গে আরো বলেন, বাংলাদেশ ইতিহাস-ঐতিহ্যে এতটা প্রাচুর্যময়, এখানে না এলে জানা হতো না তাঁর। বিদেশি নাগরিকদের সুবিধার্থে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ সাতজন গাইডের ব্যবস্থা করেছে।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের রয়েছে আনুমানিক ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার বইসংবলিত নিজস্ব গ্রন্থাগার। গবেষণার কাজে এই গ্রন্থাগার বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। এ ছাড়া রয়েছে জাদুঘর মিলনায়তন, যা বিভিন্ন কর্মশালা, সেমিনার বা সভার কাজে ব্যবহার করা হয়।
বিশেষ দিনে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে থাকে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ, তারই ধারায় কয়েক দিন আগে ৮ মে রবীন্দ্রনাথের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। জাতীয় দিবসগুলোতে চিত্রাঙ্কন, রচনা আবৃত্তি ও হাতের লেখার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়, যেখানে শিশু থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা অংশ নিতে পারে।
কীভাবে যাবেন
জাতীয় জাদুঘর শাহবাগ এলাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত। আপনার এলাকা থেকে শাহবাগ রুটের যেকোনো বাসে করে চলে আসতে পারেন এখানে।
টিকেটের মূল্য
কাউন্টার থেকে টিকেট কেটে ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। প্রধান ফটকের সামনেই অবস্থিত টিকেট কাউন্টার। যেখানে টিকেটের মূল্য ৩ থেকে ১২ বছর বয়সীদের জন্য পাঁচ টাকা, ১২ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য ১০ টাকা এবং বিদেশি দর্শনার্থীদের জন্য ৭৫ টাকা।
তবে বিভিন্ন জাতীয় দিবসে, যেমন—পয়লা বৈশাখ, ২৬ মার্চ, ২১ ফেব্রুয়ারি প্রভৃতি দিনে শিশু ও ছাত্রছাত্রীদের বিনামূল্যে প্রবেশের ব্যবস্থা করে কর্তৃপক্ষ।
দর্শনের সময়সূচি
বৃহস্পতিবার বাদে সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে জাদুঘর সবার পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত থাকে।
শনি থেকে বুধবার সকাল ১০টা ৩০ মিনিট থেকে বিকেল ৫টা ৩০ মিনিট এবং শুক্রবার বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত জাদুঘর সবার জন্য খোলা থাকে।
মনে রাখুন
১. জাদুঘরের অভ্যন্তরে ছবি তোলা থেকে বিরত রাখুন। ফোন বন্ধ রাখার চেষ্টা করুন।
২. বাইরের খাবার বা পানি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করবেন না।
৩. নিদর্শনের শোকেসগুলোতে হাত রাখা থেকে বিরত থাকুন।
৪. ক্লান্ত হলে দর্শনার্থীদের জন্য রাখা সোফাগুলোতে বিশ্রাম নিতে পারেন।
৫. বিদেশি নাগরিকদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করুন। এমন কিছু করবেন না, যাতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়।