মালয়েশিয়া রওনা হয়ে নিখোঁজ অর্ধশত যুবক
পরিবারে স্বচ্ছলতা আর একটু বাড়তি সুখের আশায় দালালদের খপ্পড়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য সমুদ্র পথেই পা বাড়ায় মাদারীপুরের প্রায় অর্ধশত যুবক। বাড়ি থেকে বের হওয়ার কিছুদিন পরই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিদেশ থেকে টাকা পাঠানো তো দূরের কথা অনেকে পরিবার আয়ের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটিকে হারিয়ে পাগলপ্রায়।
সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে, নিখোঁজদের খুঁজে বের করে উদ্ধারের। সেই সঙ্গে বিভিন্ন দেশ ভাসমান এ সব মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে। কিন্তু এতেও স্বস্তি নেই নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যদের। গগনবিদারী কান্না, আকুতি, মিনতিতে সরকারের কাছে স্বজনদের খুঁজে বের করার আকুল আবেদন তাঁদের।
সাংবাদিক দেখে সন্তান আর স্বামীর ছবি হাতে অনেকেই এনটিভির ক্যামেরার সামনে এসে দাঁড়ান। যেন এ ছবি দেখে সহজেই তাকে খুঁজে বের করতে পারে সরকার। বুক ফাটা আর্তনাদে শোনান মালয়েশিয়া পাচারকারী দালালদের খপ্পড়ে পড়ে প্রিয় সন্তানের নিখোঁজ হওয়ার করুণ কাহিনী।
আলীনুর বেপারী। মাত্র ২০ বছরে পা দিয়েছেন। পরিবারে স্বচ্ছলতার জন্য কাজ করতেন ইটের ভাটায়। পরিবারকে না জানিয়ে মাস খানেক আগে স্থানীয় দালাল শহিদুল ইসলামের প্ররোচণায় পা বাড়ান সমুদ্র পথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে। এর কয়েক দিন পরে তাঁর মাকে দালাল জানায়, আলীনুর থাইল্যান্ড পৌঁছেছেন। টাকা জোগাড় করতে হবে। এরপর থেকে বারবার দালালের সাথে আর কথাও বলতে পারেনি। এখন দালালের মোবাইলও বন্ধ থাকে।
এরপর থেকে আলীনুরের পরিবারে চলছে কান্নার রোল। মাদারীপুর সদর উপজেলার দক্ষিণ দুধখালী গ্রামের আলীনুরসহ পার্শ্ববর্তী বদিউর রহমান ও যাচ্চু মাতুব্বরের পরিবারে একই অবস্থা। উঠতি বয়সী এসব যুবক স্থানীয় দালাল চক্রের খপ্পড়ে পড়ে নিখোঁজ রয়েছে মাসখানেক আগে থেকে। সরকারের সহযোগিতায় আলীনুরকে ফেরত পাওয়ার দাবি তাঁর মা-বাবার।
আলীনুরের মা শেফালী বেগম বলেন, ‘ছেলেরে আমি কোথায় পাব, কীভাবে আমি ছেলে পাব, আমি খালি হেইয়া চাই।’
একই অবস্থা জেলার রাজৈর উপজেলার তেলিকান্দি গ্রামের সাত যুবকের পরিবারে। বাড়তি প্রলোভন দেখিয়ে বাজিতপুর ইউনিয়নের পাখুল্যা গ্রামের মানব পাচারকারী দালালচক্রের সদস্য সাদেক বয়াতী এছাহাক মল্লিক ওই সাত যুবকের প্রত্যেকের কাছ থেকে ২০ হাজার করে টাকা নেয়। এরপর থেকে খোঁজ নেই সাত যুবকের। এ ছাড়া ইশিপুর, বদরপাশা ইউনিয়নের আরো প্রায় ১০-১২ জন যুবক নিখোঁজ রয়েছে। যতই দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে নিখোঁজদের লাইন। এসব পরিবারে দাবি যে করে হোক, তাদের স্বজনদের ফিরিয়ে আনা হোক।
এক বোন বলেন, ‘আমার ভাই গেছে , থাইল্যান্ডের মানে মালয়েশিয়ার এক দালালের কাছে আমি ফোন দিছি। উনি আমার ফোন রিসিভ করে বলে যে আপনার ভাই থাইল্যান্ডে আসছে। টাকা জোগান। পরি উনি বাংলাদেশের এক দালালের নাম্বার দিছে, উনার কাচে নাম্বার দিলে উনি সব সময় ব্যস্ততা দেখান। কোনো সময় কথা বলে না সুস্থভাবে। ফোন দিলেই বলে আমি চিনি না। প্রথম বলেছে, যে আপনার ভাই ভালো আছে। আপনার ভাইয়ের সঙ্গে পরে যোগাযোগ করায় দিব। মালয়েশিয়ার ওই দালালেও এখন ফোন রিসিভ করে না। ’
স্থানীয় দালাল শহিদুলের সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলতে গেলে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। মানব পাচারকারী ও দালালদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভবিষ্যতে কেউ যাতে এই ধরনের কার্যকলাপ করতে সাহস না পায় সেই জন্য নিখোঁজদের ও দালালদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশ সুপার। সেই সাথে দালালদের আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দেন তিনি।
মাদারীপুর জেলার পুলিশ সুপার খোন্দকার ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমরা জানতে পেরেছি যে এই মানব পাচারের ভিকটিমদের মধ্যে মাদারীপুরেরও কয়েকজন রয়েছে। আমি সব থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছি একটা লিস্ট করতে যে, কারা কারা এরকম বিদেশে গিয়ে মিসিং হয়ে আছে তাদের একটা লিস্ট করতে। এদের পাঠানোর জন্য এলাকার কেউ দালালি করেছিল কি না তাদের লিস্টও করতে বলেছি।’