নিয়োগ নিয়ে এমপি-পুলিশ ‘মর্যাদার লড়াই’
ঠাকুরগাঁও জেলায় কিছুদিন আগে পুলিশের কনস্টেবল পদে লোক নেওয়া হয়েছে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ছিল পরীক্ষার তারিখ। জেলার পুলিশ লাইন মাঠে প্রায় দেড় হাজার প্রার্থী জড়ো হয়েছিলেন ওই পদের জন্য। এদের মধ্যে মাত্র ৯৬ ভাগ্যবান ব্যক্তির গায়ে চড়েছে পুলিশের পোশাক।
ওই পরীক্ষার একদিন আগে জাতীয় সংসদের প্যাডে পুলিশ কর্তৃপক্ষের কাছে নিজের পছন্দের ৪৭ জনের একটি তালিকা পাঠান ঠাকুরগাঁও-২ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) দবিরুল ইসলাম। তিনি জাতীয় সংসদের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য। ফল প্রকাশের পর নিজের তালিকার মাত্র ১৩ জনকে খুঁজে পান তিনি। এরপর সোজা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেন তিনি। অভিযোগ জেলার পুলিশ সুপার মো. আবদুর রহিম শাহ্ চৌধুরীর বিরুদ্ধে, তিনি টাকা নিয়ে পুলিশে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর লোক নিয়েছেন।
পুলিশও বসে না থেকে নিজেরা একটি তদন্ত করে। ওই তদন্ত প্রতিবেদনে পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দেয়, কোথাও কোনো উৎকোচ নেওয়ার ঘটনা ঘটেনি। উত্তীর্ণদের তালিকায় নিজের লোক না পেয়ে এমপি ওই অভিযোগ করেছেন।
ওই তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন দবিরুল ইসলাম। তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ওই পুলিশ সুপারকে রেখে নিরপেক্ষ তদন্ত করা সম্ভব নয়।’
‘প্রার্থীরা সবাই আওয়ামী লীগের’
নথিপত্রে দেখা যায়, ঠাকুরগাঁও জেলায় কনস্টেবল পদে ৮৩ জন পুরুষ এবং ১৫ জন নারীসহ মোট ৯৮ জন নিয়োগের জন্য গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এর একদিন আগে সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলাম ৭৯ জনের একটি তালিকা সুপারিশ করে পুলিশ সুপার আবদুর রহিম শাহ্ চৌধুরীর কাছে পাঠান। সদর উপজেলার ৩২ জন, বালিয়াডাঙ্গি উপজেলার ৩১ জন, হরিপুর উপজেলার ১৬ জন, রানীশংকৈল উপজেলার সাতজন, পীরগঞ্জ উপজেলার তিনজনের নাম সুপারিশ করেন দবিরুল। তবে পরীক্ষার দিন সকালে ৪৭ জনের একটি সংশোধিত তালিকা পাঠান পুলিশ সুপারের কাছে।
পুলিশের দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, দবিরুল দাবি করেছেন, তাঁর দেওয়া তালিকার ৪৭ জনই প্রত্যক্ষভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত।
এ ব্যাপারে দবিরুল ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের (সংসদ সদস্য) বলা হয়, লোক থাকলে দেওয়ার জন্য। সে জন্য আমি একটি তালিকা দেই।’
নেওয়া হয়েছে ৯৬ জন
২৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ওই পরীক্ষায় প্রায় দেড় হাজার প্রার্থীকে শারীরিক যোগ্যতা বাছাই করা হয়। এর মধ্যে ৭৩৪ জন প্রার্থীকে লিখিত পরীক্ষায় বসার অনুমতি দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২১৯ জন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এর মধ্যে পুরুষ সাধারণ কোটায় ১৪৯ জন, পুরুষ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৩৪ জন, পুরুষ পোষ্য কোটায় সাতজন, নারী সাধারণ কোটায় ২৫ জন, নারী মুক্তিযোদ্ধা কোটায় তিনজন এবং নারী পোষ্য কোটায় আছেন একজন।
প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা ও অন্যান্য সব ধরনের যাচাই বাছাই শেষে ৯৬ জন প্রার্থীকে মনোনীত করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা নারী কোটায় দুজন না থাকায় সংখ্যাটা ৯৮ হয়নি।
পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে দবিরুল ইসলামের অভিযোগের পর বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে পুলিশ। গত ৫ মার্চ পুলিশের বিশেষ বিভাগের (স্পেশাল ব্রাঞ্চ-এসবি) সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান তিন পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন পুলিশের উপমহাপরিদর্শকের (ডিআইজি-এসবি) কাছে।
ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, দবিরুল ইসলাম তাঁর দাখিল করা অভিযোগে বলেছেন, জেলার পুলিশ সুপার প্রত্যেক প্রার্থীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের উৎকোচ গ্রহণ করেছেন এবং পুলিশ সুপার নিজস্ব সোর্স দিয়ে ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে সরকারদলীয় পরিচয়পত্র গ্রহণ করেছেন।
দবিরুল দাবি করেন, পুলিশ সুপার ৬৭ জন প্রার্থীর পরীক্ষা বিশেষ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে সম্পন্ন করেছেন। এদের মধ্যে ৪৪ জনের একটি তালিকাও দিয়েছেন তিনি।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ওই ৪৪ জনের মধ্যে সুযোগ পেয়েছেন ১৪ জন। এর মধ্যে নয়জন শারীরিক পরীক্ষায় বাদ পড়েন। ৩৫ জন লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন।
প্রতিবেদনে মিজানুর রহমান বলেন, বিষয়টি নিয়ে ওই ৪৪ প্রার্থীর ঠিকানায় তিনি সরেজমিন অনুসন্ধান করেন। এ ছাড়া নিয়োগ পাওয়া আরো আটজনকে তিনি জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
‘জিজ্ঞাসাবাদে সকল প্রার্থী, অভিভাবক ও সংশ্লিষ্টদের নিকট থেকে উক্ত নিয়োগে কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায় নাই। তা ছাড়া এদের মধ্যে কেহ বিএনপি বা স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত (শিবির) রাজনীতির সহিত সংশ্লিষ্ট মর্মে কোনো তথ্য পাওয়া যায় নাই। এমনকি এদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও উল্লেখিত রাজনৈতিক দলের কোনো সম্পৃক্ততা রয়েছে মর্মে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় নাই এবং ৯৬ জন প্রার্থীর মনোনীত তালিকার প্রার্থীগণের নিয়োগে বিভিন্ন কোটা সংক্রান্তে নির্দেশনা সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয়েছে মর্মে জানা যায়,’ বলা হয় ওই প্রতিবেদনে।
‘কথা বললেই পুলিশ পেট্রলবোমার মামলা দেবে’
দবিরুল ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘পুলিশ যে এ বিষয়ে অনুসন্ধান করছে তা আমাকে জানানোই হয়নি। আমার কোনো কথা নেওয়া হয়নি।’ তিনি আরো বলেন, ‘পুলিশ টাকা নিয়েছে। বিএনপি ও জামায়াতের লোকজনদের নিয়োগ দিয়েছে। এখন কেউ কিছু বলবে না। কার ঘাড়ে দুইটা মাথা আছে যে পুলিশের বিরুদ্ধে কথা বলবে? কথা বললেই তো পুলিশ পেট্রলবোমার মামলাসহ বিভিন্ন মামলা দিয়ে দিবে।’
এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার মো. আবদুর রহিম শাহ্ চৌধুরী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘উনি (দবিরুল ইসলাম) আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। উনি কীভাবে বুঝলেন আমরা জামায়াতের লোক নিয়েছি? বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হয়েছে এবং তদন্ত প্রতিবেদনে এ নিয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে।’