ঈদে ঘোরাঘুরি
বালিয়াটি জমিদারবাড়ী, ইতিহাস যেখানে থমকে আছে
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার উত্তরে সাটুরিয়া, দক্ষিণে হরিরামপুর, পশ্চিমে ঘিওর উপজেলা এবং পূর্বে ঢাকা জেলা অবস্থিত। ঢাকা বিভাগের একটা উল্লেখযোগ্য জেলার নাম মানিকগঞ্জ। মানিকগঞ্জে যে কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে তার মধ্যে বালিয়াটি প্রাসাদ অন্যতম। একদিন হুট করে আমার কয়জন বন্ধু সকাল ৮টায় আমাকে ফোন দিয়ে বলে মানিকগঞ্জের বালিহাটি প্রাসাদ যাব, তুই যাবি? আমরা মাথায় তখন এই এলো আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই কিন্তু কখনো যাওয়া হয়নি। সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলাম। ওরা আমাকে গুলিস্তান যেতে বলল। আমি যতটুকু জানতাম ওখানে দুই ভাবে যাওয়া যায়। ঢাকার যেকোনো জায়গা থেকে গাবতলী এসে তারপর যাওয়া যায়। গাবতলী থেকে এসবি লিংক বাসে করে সরাসরি বালিয়াটি প্রাসাদ যাওয়া যায়। এসবি লিংক বাসে গাবতলী থেকে বালিয়াটি প্রাসাদ পর্যন্ত ভাড়া ৬৫ টাকা। তা ছাড়া গুলিস্তান থেকে সরাসরি বিআরটি বাস বা শুভযাত্রা বাসে ৮০ টাকা দিয়ে মানিকগঞ্জের আগের বাসস্ট্যান্ড কালাপুর নেমে ওখান থেকে সিএনজি ৩০ টাকা ভাড়া দিয়ে সরাসরি বালিয়াটি প্রাসাদ যাওয়া যায়। আমি তখন ওদের গাবতলী থেকে বালিয়াটি প্রাসাদ যাওয়ার কথা বলি। আমাদের সঙ্গে কয়েকজন মেয়ে ছিল। তারা আমার কথায় বাধা দিল। কিন্তু আমার বন্ধু আরিফ ও আমি ঠিক করলাম গাবতলী থেকে যাব। অন্যরা গুলিস্তান থেকে যাবে।
গাবতলি গিয়ে দেখলাম একটা এসবি লিংক বাস সরাসরি বালিহাটি প্রসাদ যাওয়া জন্য ডাকছে। আমরা উঠে গেলাম। আমি বাসে উঠে ইন্টারনেটে কিছু তথ্য ঘাটাঘটি শুরু করলাম। যা জানলাম তা হলো এই প্রাসাদ ঢাকা থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম দিকে এবং মানিকগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার পূর্ব দিকে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বালিয়াটি প্রাসাদ স্থানীয়ভাবে যা বালিয়াটি জমিদারবাড়ি নামেই পরিচিত। বালিয়াটির জমিদাররা উনিশ শতকের প্রথমার্ধ থেকে আরম্ভ করে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত প্রায় শতাধিক বছর বহুকীর্তি রেখে গেছেন যা জেলার পুরাকীর্তিকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছে। পুরাকীর্তির ইতিহাসে বালিয়াটি জমিদার বাড়ি এক অনন্য সৃষ্টি। খ্রিস্টীয় উনিশ শতকের দিকে এই বাড়ি নির্মিত হয়। একটি নিম্নবিত্ত সাহা পরিবার থেকেই বালিয়াটি জমিদার বংশের উদ্ভব। বালিয়াটির জমিদারদের পূর্বপুরুষ গোবিন্দ রায় সাহা ছিলেন একজন ধনাঢ্য লবণ ব্যবসায়ী। এই বাড়ির উত্তর-পশ্চিম অংশে লবণের একটা বড় গোলাবাড়ি ছিল। এই কারণে এই বাড়ির নাম রাখা হয়েছিল গোলাবাড়ি। সেকালে গোলাবাড়ির চত্বরে বারুনির মেলা বসত এবং এর পশ্চিম দিকে তাল পুকুরের ধারে আয়োজন করা হতো রথ উৎসব। এখানে বসত রথের মেলা। পর্যাপ্ত জায়গার অভাবে বর্তমানে এই স্থানে রথের মেলা হয় না। এই রথ উৎসব এখনো হয় বালিয়াটি গ্রামের পুরান বাজারের কালী মন্দিরের পাশে। তাঁর বংশের উত্তরাধিকারদের কেউ একজন জমিদারি লাভ করেন। এরাই পরে এই বাড়ি নির্মাণ করেন— গোবিন্দ রায়ের পরবর্তী বংশধর দাধী রাম, পণ্ডিত রাম, আনন্দ রাম ও গোলাপ রাম। এই পরিবারে স্মরণীয় অন্য ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন— নিত্যানন্দ রায় চৌধুরী, বৃন্দাবন চন্দ্র, জগন্নাথ রায়, কানাই লাল, কিশোরি লাল, যশোর্ধ লাল, হীরা লাল রায় চৌধুরী, ঈশ্বর চন্দ্র রায় চৌধুরী, হরেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী প্রমুখ। ঢাকার জগন্নাথ মহাবিদ্যালয় (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এদেরই বংশধর বাবু কিশোরীলাল রায়। আনুমানিক ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে বালিয়াটি জমিদার বাড়ির গোড়াপত্তন হয়। ১৩০০ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ এই বাড়ির জমিদাররা গৃহপ্রবেশ করেন বলে জানা যায়। এই জমিদার বাড়ি ৫.৮৮ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। জমিদার বাড়ির সামনেই রয়েছে একটি বড় পুকুর। বাড়িটির সম্মুখভাগে চারটি সুবিন্যস্ত সিংহদ্বার সমৃদ্ধ চারটি বিশাল প্রাসাদ পশ্চিম থেকে পূর্ব পর্যন্ত এমন সুদৃশ্যভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বর্তমানে এই পুকুরের ঘাটগুলো জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। এখানে সাতটি প্রাসাদতুল্য ইমারতে মোট ২০০টি কক্ষ আছে।
এখানে পরিদর্শের টিকিটের হার দেশি দর্শনার্থী- ২০ টাকা, সার্কভুক্ত দর্শনার্থী-১০০ টাকা, বিদেশি দর্শনার্থী- ২০০ টাকা।
এখানে পরিদর্শন সময়সূচি :
গ্রীষ্মকালীন (১ এপ্রিল থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত)
খোলার সময় : সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত
বিরতি : দুপুর ১টা থেকে ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত
শক্রবার : দুপুর ১২টা ৩০ মিনিট থেকে ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত বিরতি।
শীতকালীন (১ অক্টোবর থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত)
খোলার সময় : সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত
বিরতি : দুপুর ১টা থেকে ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত
শক্রবার : দুপুর ১২টা ৩০ মিনিট থেকে ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত বিরতি
বন্ধ : রবিবার পূর্ণদিবস ও সোমবার অর্ধদিবসসহ সরকারি ছুটির দিন। ঈদের পরের দিন এই প্রাসাদ বন্ধ থাকে।
আমরা সবার জন্য ১০টা টিকেট ২০০ টাকায় কিনলাম। এর মাঝেই অন্যরা এসে পড়ল। এখানে চারটি প্রবেশ পথ আছে। বর্তমানে জমিদার বাড়ির প্রবেশদ্বার নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি প্রবেশ পথের চূড়ায় রয়েছে পাথরের তৈরি চারটি সিংহমূর্তি। যাকে বলে সিংহ দরজা। সিংহ দরজা দিয়ে ঢুকতেই দেখলাম ছোট ছোট ফুল সমৃদ্ধ এমন প্রাচীন সৌন্দর্য। স্থানীয় লোকদের মতে, এর মূল প্রবেশদ্বার কাঠের তৈরি ছিল। এখানে পূর্ববাড়ি, পশ্চিমবাড়ি, উত্তরবাড়ি, মধ্যবাড়ি এবং গোলাবাড়ি নামে বড় আকারের পাঁচটি ভবন। জমিদারবাড়ির এই বিভিন্ন অংশ বালিয়াটি জমিদার পরিবারের উত্তরাধিকারীরাই তৈরি করেন বলে জানা যায়। এই রাজবাড়ির প্রথম সারিতে চারটি প্রাসাদ রয়েছে। এগুলোর নির্মাণ শৈলী মোটামুটি একই রকম। চার-চারটা জমিদার বাড়ী, প্রায় ৫০ ফিট উঁচু এক একটা প্রাসাদ এতই কারুকাজে পূর্ণ যে প্রতি মুহূর্তেই বিস্মিত হচ্ছি। আট ইঞ্চি করে সিঁড়ির উত্থান আর বিশাল বিশাল স্তম্ভগুলো চুন-সুরকি আর ইট দিয়ে কীভাবে কত পরিশ্রমের মাধ্যমে যে নির্মিত হয়েছিল আমরা হতবাক। প্রতিটা স্তম্ভের স্তম্ভমূল ছয় ফিটের অধিক।
গ্রিক স্থাপত্যের মতোই কারুকাজমণ্ডিত স্তম্ভের ওপরের দিকটা প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের মিশ্রণে এই প্রাসাদগুলো তৈরি করা হয়েছে। ফ্লোরাল টপসহ কোরেন্থিয়ান ধাঁচের পিলার আছে চার প্রাসাদেই। এর মাঝখানের দুটি প্রাসাদ দুই তলা এবং দুই পার্শ্বের দুটো প্রাসাদ তিন তলা। এরমধ্যে ১টি প্রাসাদে আগে কলেজ ছিল, বর্তমানে তা নাকি পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। ১নং প্রাসাদের মাঝের স্তম্ভের পিছনে থাকা গোলাকার লৌহ নির্মিত সিঁড়ি আর দেয়ালের উপরের নিঁখুত কাজগুলো যতই প্রাসাদের ভেতরে টানুক, তালাবন্ধ থাকার জন্য ভেতরে ঢুকতে পারলাম না। মূল ভবনগুলোর সামনের দেয়ালজুড়ে নানা রকম কারুকাজ আজও চোখে পড়ে। ২নং প্রাসাদের ভেতরেই বর্তমান জাদুঘর। এর দ্বিতীয় তলায় একটি রংমহল রয়েছে। এখানে জমিদারদের ব্যবহৃত নিদর্শনাদি দর্শনার্থীদের জন্য রাখা হয়েছে। নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে জমিদারদের ব্যবহৃত অসংখ্য সিন্দুক, ছোট বড় আয়না, ঝাড়বাতি, লণ্ঠন, শ্বেত পাথরের ষাঁড়, শ্বেত পাথরের টেবিল, পালঙ্ক, আলনা, কাঠ এবং বেতের চেয়ারসহ আরো অনেক নিদর্শন। মজলিস কক্ষে মূল্যবান ঝাড়বাতি রয়েছে। মজলিস কক্ষটির দেয়ালে হাতে আঁকা ছবি আছে। এর অন্দর মহলে রয়েছে তিনটি অট্টালিকা। এখানে ছিল অতিথিদের থাকার জায়গা, রন্ধনশালা, সহিস আর পরিচারকদের থাকার ঘর। সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে হলো ল্যাম্পগুলো। বিভিন্ন রকমের ল্যাম্প আর হারিকেনগুলোতে আলো জ্বললে ওই মুহূর্তেই উনিশ শতকে চলে যেতাম। ৩ নম্বর প্রাসাদেরও দরোজা বন্ধ, আর বাইরে দেখতেও একই। কিন্তু একতলা আর বাইরে ঘুরতে ঘুরতে তখন খানিকটা রাগই লাগছিল। কিছু পেলেও পেতে পারি ভেবে ২ ও ৩ নম্বর অন্দরমহলের মাঝখানের দুই ফিটের সরু গলিতে হাঁটা শুরু করলাম। যদি কোনো ভাবে ভিতরে ঢোকা যায়। কিন্তু সব জানালা আর দরজা পেরেক কাঠ দিয়ে আটকানো। কিছু অবশ্য লোহার গ্রিল ছিল। কিছু কিছু ভাঙা, তবে তার পেছনেই টিন দেওয়া। না যায় কিছু দেখা, ঢুকতে পারা তো অনেক পরের ব্যাপার। তক্ষক আর চামচিকার শব্দ শুনতে শুনতে যখন অপরপ্রান্তে বেরিয়ে আসলাম, সামনে তখন জমিদারবাড়ির পুকুর। ৬টা সিঁড়ি পুকুরে নেমে গেছে। বেশিরভাগই ভাঙা। ভুমিকম্পে ঠিক যেমন দালান কোঠা ফেটে যায়, তেমন। শান বাঁধানো ছয়টি ঘাট আছে এ পুকুরের চার পাশে, যা দেখতে সত্যিই অতি মনোহর ।
বালিয়াটিতে আজও নাকি দুই বেলা রাধা বল্লব পূজো হচ্ছে। যাই হোক তারপরও স্বভাববশত আলোচনায় পুকুরের অপরপাশের সারিবদ্ধ দরোজাগুলো দেখে আমরা ধারণা করতে লাগলাম কী হতে পারে ওইগুলো। হয়তো বা পয়োনিষ্কাশন কক্ষ কিংবা পোশাক পরিবর্তন কক্ষ। কাছে গিয়ে দেখি সারিবদ্ধ কক্ষগুলো সব পয়োনিষ্কাশন কক্ষ । আর গুটিকয়েক পোশাক পরিবর্তন কক্ষ। অদ্ভুত হলেও যেখানে আমরা আধুনিক সমাজে প্রতিটা কক্ষের সাথে একটা করে পয়োনিষ্কাশন কক্ষ দেখি, সেখানে এই প্রাসাদগুলোতে পয়োনিষ্কাশন কক্ষ একদম পিছনে। আর বলতে গেলে আলাদাই। পুকুরের সিঁড়িও পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা। পুর্ব পার্শ্বের একটি সিঁড়ি এখন আর নেই। তারমানে পুকুরে নামার জন্য সাতটা সিঁড়ি ছিল। সব মিলিয়ে ৫টা কুয়ো চোখে পড়ল। সবই ভরাট হয়ে গেছে।
অন্দর মহলের বাইরের কারুকাজ দেখে ৪ নম্বর প্রাসাদের সামনে এলাম। বালিয়াটিতে ১৯২৩ সালের দিকে জমিদার কিশোরী রায় চৌধুরী নিজ ব্যয়ে একটি এলোপ্যাথিক দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। বর্তমানে এটি সরকারি নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে। জমিদার হীরালাল রায় চৌধুরী সাটুরিয়া থেকে বালিয়াটির প্রবেশ পথের পাশে কাউন্নারা গ্রামে একটি বাগানবাড়ী নির্মাণ করেন এবং সেখানে দীঘির মাঝখানে একটি প্রমোদ ভবন গড়ে তোলেন যেখানে সুন্দরী নর্তকী বা প্রমোদ বালাদের নাচগান ও পান চলত। বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর দৃষ্টিনন্দন ও প্রাসাদের রক্ষণাবেক্ষণ করছে। আমাদের ঘুরতে ঘুরতে ৫টা বেজে গেল। আমরা আবার এসবি লিংক বাসে করে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম। কেউ যদি একদিনের জন্য ঢাকার আশপাশে ঘুরতে চান তাহলে বালিয়াটি জমিদারবাড়ি ঘুরে আসতে পারেন। সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেন খাবার-দাবার। অবশ্য রাজবাড়ির আশপাশে হোটেলও আছে। তবে ভ্রমণে নিজের সঙ্গে খাওয়ার পানি রাখতে ভুলবেন না।