‘নুসরাতের শরীরে কেরোসিন ঢালে জাবেদ, আগুন দেয় জোবায়ের’
ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা মামলার হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আসামি কামরুন নাহার মণি। তিনি এই মামলার ১৬তম আসামি।
কামরুন নাহার মণি সোনাগাজী পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন ঈমান আলী হাজি বড়ির বিজিবি সদস্য মরহুম আজিজুল হকের পালিত কন্যা। ওই মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী ছিলেন তিনি। গত ৯ এপ্রিল তাঁকে বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি বিবাহিত। পরে কারাগারে তিনি সন্তানের জন্ম দেন।
আসামি জবানবন্দিতে বলেন, ‘গত ২ এপ্রিল উম্মে সুলতানা পপি আমাকে দুই হাজার টাকা দিয়ে বলে শাহাদাত হোসেন শামীম বলেছে, আমাকে বোরকা ও চারটি মোজা কিনে সাইক্লোন শেল্টারের দ্বিতীয় তলায় দুটি কক্ষের যেকোনো একটিতে রাখতে। আমি বোরকার বিষয়ে প্রশ্ন করলে, পপি বলে, না কিনলে আমার পরীক্ষা দিতে সমস্যা হবে। আমি তখন বোরকা কেনার টাকা নিই।’
জবানবন্দিতে মনি আরো বলেন, ‘গত ২ এপ্রিল দুপুর দেড়টায় সোনাগাজী বাজারের মানিক প্লাজার ওয়ার্ল্ড ফ্যাশন বোরকা হাউস থেকে এক হাজার ৯৮০ টাকা দিয়ে দুইটা কালো রঙের বোরকা কিনি। বোরকা কেনার পরে ফুটপাত থেকে চার জোড়া কালো রঙের হাতমোজা কিনি। এগুলো আমি বাড়িতে নিয়ে রাখি। পরে গত ৬ এপ্রিল ৯টা ২০ মিনিটে মাদ্রাসায় যাই। মাদ্রাসায় ঢুকে পপির কথামতো সাইক্লোন শেল্টারের দোতলায় বোরকা ও মোজা নিয়ে প্রিন্সিপাল হুজুরের অফিসের পাশের রুমে ঢুকি। রুমে ঢুকে শামীম, জোবায়ার ও জাবেদকে দেখি।’
‘আমি শামীমের হাতে রোরকা ও মোজাগুলো দিই। তারা আমাকে ছাদে যেতে বলে। আমি রুম থেকে বের হয়ে ছাদে না গিয়ে নিচে যাই। একটু পরে ছাদে যাই। আমি ছাদে গিয়ে শাহাদাত হোসেন, জাবেদ ও জোবায়েরকে দেখি তারা বোরকা ও হাতে মোজা পরা অবস্থায়। পরে উম্মে সুলতানা পপি আসে। তারপরে নুসরাত জাহান রাফি আসে। নুসরাত নিশাতকে খুঁজতে থাকে। এর মধ্যে শামীম পপিকে হুজুরের বিরুদ্ধে করা মামলা তুলে নেওয়ার জন্য একটি কাগজ দেয় এবং তাতে নুসরাতের স্বাক্ষর নিতে বলে। কিন্তু নুসরাত রাজি হয়নি।’
জবানবন্দিতে মণি বলেন, ‘নুসরাত রাজি না হওয়ায় শামীম পপিকে নুসরাতের ওড়না খুলে দিতে বলে। পপি ওড়না খুলে জোবায়েরের হাতে দেয়। জোবায়ের ওই ওড়না লম্বা লম্বা ভাগাভাগি করে ফেলে। শামীম পপিকে বলে নুসরাতের হাত বাঁধতে। এর পরে শামীম নুসরাতের মুখ চেপে ধরে। শামীম তখন নুসরাতকে নিচে ফেলে দেয়। জোবায়ের নুসরাতের পা ধরে রাখে। পপি ওড়নার অর্ধেক পার্ট দিয়ে নুসরাতের পা বেঁধে রাখে। এ সময় আমি কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। শামীম আমাকে নুসরাতের পা চেপে ধরে বলতে বলে। আমি রাজি না হলে শামীম আমার পেটে থাকা বাচ্চাকে লাথি মেরে ক্ষতি করে দেবে বলে হুমকি দেয়। আমি পাঁচ মাসের গর্ভবতী। আমি ভয়ে শামীমের কথামতো নুসরাতের বুক চেপে ধরি। শামীম তখন জাবেদকে বলে বাথরুমের পাশে রাখা কেরোসিন নিয়ে আসতে। তখন জাবেদ নুসরাতের শরীরে কেরোসিন ছিটিয়ে দেয়। পলিথিনে কেরোসিন ছিল। জোবায়ের ম্যাচের কাঠি দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে জলন্ত কাঠি নুসরাতের শরীরে মারে। আমি ভয়ে একদিকে সরে যাই ও নিচে নেমে যাই। আমার ওই দিন আরবি পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষা শেষে আমাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।’
নুসরাত হত্যার নেপথ্যে
মামলার বিবরণে জানা যায়, ফেনী সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলীম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে চলতি বছরের ২৬ মার্চ ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা তাঁর অফিসকক্ষে ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। এ ঘটনায় নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী থানায় অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে আসামি করে একটি মামলা করেন। এ মামলায় গত ২৭ মার্চ পুলিশ অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে গ্রেপ্তার করে।
সিরাজ-উদ-দৌলার নির্দেশে মাকসুদ কমিশনার, সাহাদাত হোসেন শামীম তাঁদের অনুসারীদের নিয়ে অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে সোনাগাজী বাজারে মানববন্ধন করে এবং থানা ঘেরাও করার চেষ্টা করে। একই সঙ্গে সিরাজ-উদ-দৌলার অনুসারীরা নুসরাতকে মামলাটি উঠিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু নুসরাত মামলা উঠিয়ে নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
পরে গত ৬ এপ্রিল সকালে নুসরাত আলিমের আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে মাদ্রাসায় গেলে দুর্বৃত্তরা তাকে ডেকে কৌশলে মাদ্রাসার ছাদে নিয়ে যায়। পরে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। দগ্ধ নুসরাত ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাঁচ দিন পর ১০ এপ্রিল রাতে মারা যায়।
পরদিন ১১ এপ্রিল বিকেলে সোনাগাজীতে জানাজা শেষে নুসরাতকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে ৮ এপ্রিল নুসরাতকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। পরে সেটি হত্যা মামলায় রূপান্তর করা হয়।
নুসরাতের ওপর হামলার ঘটনায় ফেনী, সোনাগাজীসহ সারা দেশের মানুষ ফুঁসে ওঠে। মশাল মিছিল, মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল করে দোষীদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করে।
তবে নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার জন্য স্থানীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠী, থানা পুলিশ, কয়েকজন সুবিধাভোগী সাংবাদিক মরিয়া হয়ে অপপ্রচার চালাতে থাকে। সে সময়ের জেলা পুলিশ সুপার এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনের পক্ষে সাফাই গেয়ে নুসরাত আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে বলে পুলিশ সদর দপ্তরে প্রতিবেদন দেয়।
এ প্রতিবেদনের কারণে পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকারকে ফেনী থেকে প্রত্যাহার করে ঢাকা পুলিশ সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। একই সময়ে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকের প্রত্যাহার করা হয়। এর আগে গত ২৭ মে নুসরাতের শ্লীলতাহানির ঘটনায় ওসি মোয়াজ্জেম নুসরাতকে থানায় জিজ্ঞাসাবাদের নামে হেনস্তা করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভিডিও প্রচারের এ ঘটনায় আইসিটি আইনে মামলায় ওসি মোয়াজ্জেম বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন।
পরে এ মামলা তদন্ত করার জন্য পিবিআইর কাছে হস্তান্তর করা হয়। তদন্ত শেষে গত ২৯ মে ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসেনের আদালতে ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দেন নুসরাত হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক মো. শাহ আলম।
এ মামলায় আটক থাকা চার্জশিটের বাইরের পাঁচজনকে বিচারিক আদালত মামলার দায় থেকে অব্যহতি দেন। তাঁরা হলেন কেফায়েত উল্লা, আরিফুল ইসলাম, নূর হোসেন, সাইদুল ইসলাম ও আলাউদ্দিন।
অভিযোগপত্রভুক্ত ১৬ আসামির মধ্যে ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ৩০ মে মামলাটি ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ১০ জুন আদালত মামলাটি আমলে নিলে শুনানি শুরু হয়। ২০ জুন অভিযুক্ত ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বিচারিক আদালত। এর পর ২৭ ও ৩০ জুন মামলার বাদী ও নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানকে জেরার মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। এর পর মোট ৯২ সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জনের সাক্ষ্য নেন আদালত।
মামলায় যারা আসামি
চাঞ্চল্যকর এই মামলায় উভয়পক্ষের শুনানি শেষ হয় গত ৩০ সেপ্টেম্বর। তারপরই আদালত রায়ের জন্য দিন নির্ধারণ করেন। মামলার বিচারকাজ শুরুর ৬২ দিনের মধ্যে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করা হয়।
এ মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ১৬ জন। তাঁরা হলেন প্রধান আসামি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ-উদ-দৌলা, দুই নম্বর আসামি ফেনী কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ও অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের আহ্বায়ক মো. নুর উদ্দিন, তিন নম্বর আসামি মাদ্রাসার ফাজিলের ছাত্র শাহাদাত হোসেন শামীম, চার নম্বর আসামি পৌর আওয়ামী লীগের সদ্য বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক এবং ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, পাঁচ নম্বর আসামি ছাত্রলীগকর্মী ও মাদ্রাসার ফাজিল বিভাগের ছাত্র মো. জোবায়ের, ছয় নম্বর আসামি চরচান্দিয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি ও মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী জাবেদ হোসেন, সাত নম্বর মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের শিক্ষক এবং ফাজিল দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র হাফেজ আবদুল কাদের, আট নম্বর আসামি মাদ্রাসার ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক আফছার উদ্দিন।