পুলিশের ওপর মানুষের আস্থা বাড়বে
ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার দায়ে ১৬ আসামির সবার ফাঁসির আদেশের ফলে পুলিশের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়বে বলে মনে করছে এ মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে আসামিদের ফাঁসির আদেশের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা জানান এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. ইকবাল।
ইকবাল বলেন, ‘এ মামলা তদন্ত করার দায়িত্ব আমাদের পিবিআইর ওপর পড়েছিল। এবং আমরা এ মামলাটি সততা, নিষ্ঠা ও দ্রুততার সঙ্গে ৩৩ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে বিজ্ঞ আদালতে চার্জশিট দিয়েছিলাম। দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারকার্য শেষ করে আজ রায় প্রদান করা হয়েছে। আমরা যে তদন্ত করেছি, রায়ের মাধ্যমে তার প্রতিফলন হয়েছে। আমরা মনে করছি, এ রায়ের মাধ্যমে যারা অপরাধী, তারা আতঙ্কিত হবে এবং যারা সাধারণ মানুষ, তারা স্বস্তি পাবে। এ তদন্তের মাধ্যমে পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পাবে বলে আমরা মনে করছি।’
ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ আজ বৃহস্পতিবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাসহ ১৬ খুনির সবার ফাঁসির আদেশ ও প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করেন। এই টাকা নুসরাতের পরিবারকে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। সব আসামির উপস্থিতিতে এ রায় দেন বিচারক।
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নুসরাতের পরিবার ও তাঁর আইনজীবী। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী আপিল করার কথা বলেছেন।
ফাঁসির আদেশ পাওয়া মামলার ১৬ জন হলেন—প্রধান আসামি সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ-উদ-দৌলা, দুই নম্বর আসামি ফেনী কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ও অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের আহ্বায়ক মো. নূর উদ্দিন, তিন নম্বর আসামি মাদ্রাসার ফাজিলের ছাত্র শাহাদাত হোসেন শামীম, চার নম্বর আসামি সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সদ্য বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, পাঁচ নম্বর আসামি ছাত্রলীগকর্মী ও মাদ্রাসার ফাজিল বিভাগের ছাত্র মো. জোবায়ের, ছয় নম্বর আসামি চরচান্দিয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি ও মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী জাবেদ হোসেন, সাত নম্বর আসামি মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের শিক্ষক ও ফাজিল দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র হাফেজ আবদুল কাদের এবং আট নম্বর আসামি মাদ্রাসার ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক আফছার উদ্দিন।
ক্রমানুসারে অন্য আসামিরা হলেন মাদ্রাসার ফাজিল প্রথম বর্ষ ও ফেনী পলিটেকনিক কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র আবদুর রহিম ওরফে শরীফ, অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের সদস্য ও ছাত্রলীগকর্মী মো. শামীম, অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের সদস্য ও ফেনী কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র এমরান হোসেন মামুন, মাদ্রাসা শাখা ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ইফতেখার উদ্দিন রানা, অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের সদস্য ও ছাত্রদলকর্মী হিসেবে পরিচিত মহিউদ্দিন শাকিল, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. রুহুল আমিন, মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী উম্মে সুলতানা পপি ও মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী কামরুন নাহার মণি।
রায়ের আগে আজ সকাল ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে ফেনী জেলা কারাগার থেকে মামলার ১৬ আসামির সবাইকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। পিনপতন নীরবতার মধ্যে বিচারক রায়ের কাজ শুরু করেন।
মামলার রায় শুনতে আদালতে নুসরাতের পরিবারের সদস্য, মামলার আইনজীবী, গণমাধ্যমকর্মী ও আসামিদের স্বজনরা হাজির ছিলেন। আদালত চত্বরে কড়া নিরাপত্তার মধ্যেও উৎসুক মানুষের ভিড় লক্ষ করা গেছে।
এর আগে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে একটি প্রিজনভ্যানে করে আসামিদের কারাগার থেকে বের করা হয়। ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে তাদের আদালত চত্বরে নিয়ে আসা হয়। এ সময় প্রিজনভ্যানটিকে মাঝখানে রেখে দুইপাশে ছিল পুলিশের গাড়ি। তারপর হাতকড়া পরা অবস্থায় সারিবদ্ধভাবে আসামিদের প্রিজনভ্যান থেকে নামিয়ে আদালতের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে নিয়ে যাওয়া হয়। কাঠগড়ায় আসামিদের উদ্বিগ্ন দেখা যাচ্ছিল। কামরুন নাহার মণি তাঁর সদ্যোজাত কন্যাসন্তানকে নিয়েই কাঠগড়ায় উপস্থিত হন। রায় পড়ার সময় আসামিরা দোয়া পড়ছিলেন। রায় শোনার পর পরই আসামিরা কাঠগড়ায় কান্নায় ভেঙে পড়েন।
এ মামলায় উভয়পক্ষের শুনানি শেষ হয় গত ৩০ সেপ্টেম্বর। তারপরই আদালত রায়ের জন্য দিন নির্ধারণ করেন। মামলার বিচারকাজ শুরুর ৬২ দিনের মধ্যে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করা হয়। দ্রুততম সময়ে এই মামলার বিচারকাজ শেষ করা একটি দৃষ্টান্ত বলে উল্লেখ করেছেন আদালত-সংশ্লিষ্টরা।
মামলায় সোনাগাজী ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। আসামিদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের উপজেলা কমিটির সভাপতি, প্রভাবশালী কাউন্সিলর, ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের কর্মী থেকে শুরু করে মাদ্রাসার শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীরাও রয়েছেন।