চিরকুটের ‘বর্ষায় কথা ও কবিতা’ অনুষ্ঠান
‘কবি কখনো সাম্প্রদায়িক হতে পারে না, কবিতা কখনো সাম্প্রদায়িক হয় না। একজন কবি যখন একটি কবিতা লেখেন, তখন হয়ে যায় চিরকালীন এবং সর্বজনীন।’ বলছিলেন কবি খালেদ হোসাইন। প্রথিতযশা এই কবির সরব উপস্থিতিতে বেশ সরগরমই হয়ে ওঠে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহত্তম সাহিত্য সংগঠন চিরকুটের ২৫তম সাহিত্য আড্ডা ‘বর্ষায় কথা ও কবিতা’। গতকাল বুধবার ১৪ শ্রাবণ ১৪২২ বিকেল ৫টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়া চত্বরে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল অনুষ্ঠানটি। অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক খোরশেদ আলম ও কবি সালাম সাকলাইন।
সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সব সময়ই অন্যদের চেয়ে অগ্রগামী। প্রাকৃতিক নৈঃস্বর্গ, ঝঞ্ঝাটহীন ক্যাম্পাস সাহিত্যপ্রেমীদের নিমগ্ন রাখে পড়া ও লেখায়। এরা এক হয়ে আড্ডা দেয়, সাহিত্যের একাল-সেকালের নানা প্রশ্ন-উত্তর আর অভিমতে আড্ডা হয় প্রাণচঞ্চল। এসব নবীন সাহিত্যিকের পথচলায় অনুপ্রেরণা জোগান কবি খালেদ হোসাইনের মতো অগ্রজরা। তাই এদের কথা শোনার জন্য এবং আড্ডা দেওয়ার জন্য চিরকুট প্রতি বুধবারই আয়োজন করে সাহিত্য আড্ডা। যেখানে প্রিয় কবি কিংবা সাহিত্যিকদের কথা শোনার জন্য এবং আড্ডা দেওয়ার জন্য ভিড় জমায় অনেকেই। এবারের আড্ডাও তার ব্যতিক্রম ছিল না, তবে ছিল আরো তাৎপর্যময় এবং সরগরম। বিকেল ৫টা বাজার আগে থেকেই উপস্থিত হতে থাকে ছাত্রছাত্রীরা। আড্ডায় সঙ্গ দিতে চলে আসেন কবি সালাম সাকলাইন। তিনি তাঁর স্মৃতির পাতা থেকে তুলে ধরেন সেকালের সাহিত্য আড্ডার কথা এবং এর তাৎপর্য। তিনি বলেন, ‘আমাদের সময়ের আড্ডার সাথি ছিলেন কবি খালেদ হোসাইন, রায়হান রাইনরা। আজ তাঁরা বড় কবি-সাহিত্যিক। তোমাদের এসব আড্ডা থেকেই দেখা যাবে অনেকে অনেক বড় সাহিত্যিক হয়েছ। এই আড্ডাগুলোর গুরুত্ব অনেক।’ সবাই তাঁর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকে। তবে মূল অনুষ্ঠান তখনো শুরু হয়নি। কারণ, প্রধান অতিথি কবি খালেদ হোসাইন তখনো এসে পড়েননি। সালাম সাকলাইনের আলাপ চলতে চলতেই হাজির হয়ে যান আড্ডাপ্রাণ খালেদ হোসাইন, সঙ্গে খোরশেদ আলম। শিক্ষকদের উপস্থিতি সবাইকে অভিবাদন এবং বর্ষার শুভেচ্ছা জানিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করেন চিরকুটের সম্পাদক কবি মাসুম মুনাওয়ার। অনুষ্ঠানের শুরু হয় কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমেই। তার পর কয়েকজন কবি পাঠ করেন স্বরচিত কবিতা। তরুণ কবিদের প্রশ্নে আলোচনা শুরু করেন কবি খালেদ হোসাইন। ততক্ষণে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। শিক্ষকরা তো বিস্মিত, কবিতার আড্ডায় এত লোক হয়!
যরির অদিতি জানতে চান কবিতা অশ্লীলতা সম্পর্কে কিংবা আমরা কোনগুলো অশ্লীল বলব। খালেদ হোসাইন বলেন, ‘সমাজের দৃষ্টিতে যা অসুন্দর, তা-ই অশ্লীল।’ এভাবেই চলতে থাকে আলোচনা এবং কবিতা পাঠ। মাঝেমধ্যে আবৃত্তি করে শোনান ক্যাম্পাসের আবৃত্তি সংগঠন 'ধ্বনি' থেকে আসা আবৃত্তি শিল্পীরা। আবৃত্তি শিল্পী জ্যোতি আবৃত্তি করে শোনান কবি খালিদ হোসাইনের একটি কবিতা।
বর্ষার সঙ্গে কবিতার একটা সম্পর্ক আছে। কবিদের মধ্যেও বর্ষার প্রভাব চরম। এর কারণ তো আছেই, বর্ষার মতো নির্মল, সুন্দর ঋতু আমরা পাব কোথায়। বর্ষার রিমঝিম বৃষ্টি আমাদের মন থেকে ধুয়ে নিয়ে যায় বিষণ্নতা, আমাদের আন্দোলিত করে রোমান্স। তখন রবীন্দ্রনাথের মতো আমাদের মনে পড়ে প্রেয়সীর মুখ, কবির বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে কোনো হৃদয়স্পর্শী কবিতা। তাই চিরকুটের ২৫তম সাহিত্য আড্ডার স্লোগানও ছিল তেমনি, ‘বৃষ্টির ফোঁটায় ছড়িয়ে পড়ুক কবিতা’। অনুষ্ঠানের সময় বৃষ্টি ছিল না, কিন্তু কবিতা ছড়াতে বাদ থাকেনি। অনুষ্ঠানে আরো কবিতা পাঠ করেন কবি কলি মাহমুদ, তসলিম হাসান, মাসুম মুনাওয়ার, সানাউল্লাহ মাহী, যরির অদিতি, তানজিলা তানি, খালিদ হাসান তুষার, জুলফিকার রবিন, দুলু সরকার, সুজন বাড়ৈ, সালমান মাহফুজ, সা'দ আশরাফসহ আরো অনেকেই। তরুণ কবিদের কবিতা শুনে মুগ্ধ হন অতিথিরা। ঢাকা থেকে আসা অতিথি কবি লাওহে মাহফুজ বলেন, ‘আমরা হয়তো কবিতা থেকে দূরে সরে গেছি, কিন্তু এটা উচিত নয়। আমাদের উচিত, প্রিয় কবিকে খুঁজে বের করা, এ জন্য পড়তে হবে প্রচুর। এই তরুণদের মধ্যেই মিলে যেতে পারে প্রিয় কবি।’ খোরশেদ আলম বলেন, ‘যে ভাষায় আল মাহমুদ, জয় গোস্বামীর মতো কবির জন্ম, সে ভাষার কবি তো মধুর হবেই, সে ভাষার মানুষ তো কবিতাপ্রেমী হবেই।’ আসলেই তো তাই, হয়তো সে কারণেই এত সুন্দর বাংলা কবিতা, এত কবিতাপ্রেমী আমরা।
আড্ডায় আড্ডায় রাত ঘনিয়ে আসে। অনুষ্ঠান তখন একেবারে শেষে। চলতে থাকে ফটোসেশন আর এক কোণ থেকে ধ্বনির আবৃত্তি শিল্পী মুজাহিদের উচ্চ কণ্ঠে ভেসে আসতে থাকে—
‘আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই
আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ন নৃত্য দেখি
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে…’