জন্মদিন
জন লেননের রাজনৈতিক পরিচয়
‘ভাবুন কোনো স্বর্গ নেই
ভাবুন কোনো দেশ নেই
আপনি বলতে পারেন
আমি একজন স্বপ্নবাজ
কিন্তু আমি একাই না
আশা করি একদিন আপনিও
আমাদের দলে যোগ দেবেন
এবং সেদিন এই পৃথিবীটা এক হয়ে যাবে।’
ইমাজিন গানের মাধ্যমে এভাবেই নিজের স্বপ্নের কথা জানিয়েছিলেন জন উইনস্টন ওনো লেনন। সংক্ষেপে জন লেনন, বিটলসের লেনন। শান্তির গান গাইলেও তাঁর প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল আততায়ীর বুলেট। ১৯৪০ সালের আজকের দিনে (৯ অক্টোবর) জন্ম নিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের লিভারপুলে। সেখানেই বড় হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
শৈশব থেকেই জড়িয়ে পড়েন গান-বাজনার সঙ্গে। তাঁর প্রথম ব্যান্ড ছিল ‘দ্য কোয়ারিমেন’। এর পর ১৯৬০ সালে বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তোলেন ‘বিটলস’। কিন্তু ১০ বছর পর ১৯৭০ সালে ভেঙে যায় বিটলস। এর পর গায়ক হিসেবে সলো ক্যারিয়ার শুরু করেন লেনন। ১৯৬৯ সালে ইয়োকো ওনোকে বিয়ে করেন। তারপর নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন জন ওনো লেনন।
জন লেনন আর বিটলস জড়িয়ে আছে একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে এবং সে কথাগুলো এখনো মনে আছে অনেকের। ষাটের দশকে একদিকে জন লেননের তরতর করে বেড়ে ওঠা, অন্যদিকে বিটলস গঠন নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। জন লেনন ওই ষাটের দশকেই প্রথমে জড়িয়ে গেলেন প্রগতিশীল ধারার সঙ্গে। তিনি গাইলেন ‘গিভ পিস এ চান্স’ এবং ‘ওয়ার্কিং ক্লাস হিরো’র মতো বিখ্যাত গান।
পরে আয়ারল্যান্ডের ব্রিটিশ আধিপত্যের বিরুদ্ধেও তিনি জোরালো ভূমিকা রাখেন। ষাটের দশকের প্রগতিশীলতার চিন্তা তাঁর মধ্যে বজায় ছিল সত্তরের দশকেও। কিন্তু জন লেননও ষাটের দশকের অনেকের মতোই দিকনির্দেশনাহীন হয়ে পড়লেন। পরবর্তীকালে তিনি তাঁর বাম প্রগতিশীল চিন্তা ও কর্মকাণ্ড নিয়ে ভেবেছেন এবং একপর্যায়ে এ ব্যাপারে চুপচাপই হয়ে গেলেন।
মুরিস হিন্ডলে লেনন সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘প্রগতিশীল বাম ঘরানার সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য জন লেনন একসময় আফসোস করেছেন। আমি এখনো তাঁর বিশ্বাস এবং কণ্ঠকে সস্নেহে স্মরণ করি।’
মুরিস হিন্ডলের এই কথা লেননের রাজনৈতিক বিশ্বাস সম্পর্কে বেশ কিছু প্রশ্ন তুলেছিল মানুষের মনে। ১৯৬৯ সালে বিটলসের ‘রেভল্যুশন’ অ্যালবাম বের হওয়ার পর লেনন বামপন্থী বাহাসে বসতে চেয়েছিলেন। লেননের সঙ্গে সে সময় তারিক আলীর বেশ ওঠাবসা ছিল।
তারিক আলী পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক। বাম ঘরানায় তিনি একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। লেখক, সাংবাদিক এবং চলচ্চিত্রকার আলী ছিলেন লেননের বন্ধুমহলের অংশ। অতি বাম ঘরানার চিন্তা-চেতনা এবং ভাবনা নিয়ে লেননের একটি সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলেন তিনি। সে সময় থেকেই লেননের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা শুরু হয়।
সেই সাক্ষাৎকারের পরই লেনন বাম আন্দোলন নিয়ে একটি গান লিখেছিলেন এবং গেয়েছিলেন। যে গানের প্রথম লাইন ছিল ‘পাওয়ার টু দ্য পিপল’।
১৯৭২ সালে আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতার দাবিতে চালানো আন্দোলনে গুলি চালানোর সেই রক্তাক্ত রোববার লেননকে বেশ আলোড়িত করেছিল। তিনি এর প্রতিবাদ করেছিলেন। স্ত্রী ইওকো ওনোকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন আয়ারল্যান্ডে। লাল টি-শার্ট পরা লেননের উঁচু হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘আয়ারল্যান্ডের জন্য, ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে।’
জন লেননের বিখ্যাত গান ‘ইমাজিন’ রেকর্ডের সময় বন্ধু তারিক আলীকে ব্ল্যাকবার্নে ডেকেছিলেন তিনি। তারিক আলীর বিভিন্ন সময়ের স্মৃতিচারণে লেনন এসেছেন। এসেছে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন, গান-বাজনা এবং ভেতরকার মানুষ।
গানটা কম্পোজের আগে বন্ধু-বান্ধবদের আড্ডায় লেনন গানটা গুনগুনিয়ে গাইতেন এবং জানতে চাইতেন গানটা কেমন লেগেছে সবার। তারিক আলী মজা করে বলতেন, ‘পলিটব্যুরো এই গানটাকে ভালো বলেছে।’ ইমাজিন গানটা লেখার সময় লেনন প্রগতিশীল বাম আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন বেশ ভালোভাবেই। ১৯৭০-এর দশকে এই গান গেয়েই হয়তো নিজের রাজনৈতিক পরিচয় স্পষ্ট করতে চেয়েছিলেন লেনন।
লেননের রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে অনেক সময় কথা উঠলেও তাঁর ছায়াসঙ্গী ইওকো ওনোর মতাদর্শ কিন্তু সে তুলনায় আড়ালেই রয়ে গেছে। শিল্পচর্চা এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ওনো প্রগতিশীলতার ছাপ রেখে গেছেন। লেননকে বুঝতে হলে ওনো গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সত্তরের দশকে লেননের চিন্তা-ভাবনায় স্পষ্টভাবেই ছায়া ফেলেছিলেন ওনো।
ব্রিটেনে সোজাসাপ্টা কথা বলে লেনন যখন বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন, দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিতে চেয়েছিলেন, তখন তারিক আলী তাঁকে আটকে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। তারিক বলেছিলেন, ‘বড্ড বেশি পাগলামি হয়ে যাচ্ছে।’ জবাবে লেনন বলেছিলেন, ‘ম্যানহাটনের জন্য ঠিক আছে!’
লেননের ইংল্যান্ড ছেড়ে যাওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল, মূলত ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক সমাজব্যবস্থা। এ ছাড়া ওনোকে উদ্দেশ করে সে সময়কার ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলোর বর্ণবাদী আচরণ। আলীর সঙ্গে লেননের শেষ কথা হয়েছিল ১৯৭৯ সালে মার্গারেট থ্যাচারের বিজয়ের পর।
থ্যাচারের বিজয় সম্পর্কে লেননের মতামত জানতে চেয়েছিলেন আলী। সে সময় লেনন খুব বেশি কথা বলেননি, এমনকি তাঁর কথায় প্রগতিশীল ছাপও ছিল না। তবে তারিক আলী বলছেন, ‘জন লেননের কিছু পরিবর্তন এসেছে বটে, তবে এমন পরিবর্তন আসেনি, যাতে কি না তিনি প্যালেস্টাইন, আফগানিস্তান, ইরাকের যুদ্ধ ও দখলদারিত্বকে সমর্থন করেন। জন লেননের অনুপস্থিতি কোটি কোটি মানুষের জন্য দুর্ভাগ্যেরই একটি বিষয়।’