ব্রিটেন ও ভারতের বিমা কোম্পানি বিনিয়োগ করবে বাংলাদেশে
বাংলাদেশে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে বিনিয়োগ করবে ব্রিটেন ও ভারতের বিমা কোম্পানি। কোম্পানি দুটি হচ্ছে- ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি লাইফ ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন (এলআইসি) ও ব্রিটিশ বহুজাতিক বিমা কোম্পানি প্রুডেনশিয়াল পিএলসি। এ দেশে বিনিয়োগে এলআইসির প্রস্তুতি শেষের পথে। আর প্রুডেনশিয়ালেরও কাজ এগিয়ে চলছে।
বিমা ব্যবসার ক্ষেত্রে বিদ্যমান শর্ত পূরণ করে কয়েকটি দেশীয় কোম্পানির সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে বিদেশি কয়েকটি কোম্পানির ব্যবসার আগ্রহের কথাও জানা গেছে। এরই মধ্যে দেশীয় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছে পাকিস্তানের নিউ জুবিলি ইন্স্যুরেন্স, সিঙ্গাপুরের স্কোর এবং শ্রীলঙ্কা ও জাপানের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
জাপানি কোম্পানি তাইও-সামিট ব্যবসা শুরুর কথা বলে থাকলেও শর্তপূরণ না করতে পারায় তাদের অনুমোদন বাতিল হয়েছে বলে জানিয়েছে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।
আইডিআরএর সদস্য জুবের আহমেদ খান বলেন, ‘এলআইসির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরুর প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে। আইনগতভাবে বাজারে আসার প্রস্তুতিতে তেমন কোনো জটিলতা নেই। আর ব্রিটেনের প্রুডেনশিয়ালের কাগজপত্র নিয়ে কাজ চলছে। কবে নাগাদ বাজারে আসবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে খুব বেশি দেরিও হবে না।’
আরো কোম্পানি আসছে কি না– জানতে চাইলে জুবের আহমেদ খান বলেন, ‘কোনো কোম্পানি এ দেশে ব্যবসা করতে চাইলে যে কোম্পানির সঙ্গে কাজ করবে তার সঙ্গে আলাপ চূড়ান্ত করার পর আমাদের কাজ শুরু হয়। কয়েকটি কোম্পানির আলোচনার খবর শুনলেও এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ কাগজ জমা দেয়নি।’
চলতি বছরের ৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের সময় এলআইসির চেয়ারম্যানের কাছে আইডিআরএর সম্মতিপত্র তুলে দেওয়া হয়। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানে এক লাখ ২০ হাজার কর্মী কাজ করেন। এলআইসির সম্পদের পরিমাণ ১৫ লাখ ৬০ হাজার ৪৮২ কোটি রুপি।
বিশ্লেষকদের মতে, বিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশে বিমা খাতে এলে এ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে। অনেকের কর্মসংস্থান হবে। মানুষের মনে বিমা নিয়ে যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে তাঁর অনেকটাই নিরসন হতে পারে। পাশাপাশি দুর্নীতিও কমতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, বিদেশি কোম্পানি বিনিয়োগে এলে দেশের কোম্পানিগুলোর কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতার তাগিদ আসবে। দেশের সাগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নতুন মাত্রা যোগ হবে।
তবে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দেশীয় পুরনো কোম্পানিগুলো কতটুকু টিকতে পারবে তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন এ খাতের সঙ্গে যুক্ত অনেকে। তাঁদের মতে, প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারলে কোনো কোনো দেশীয় কোম্পানির ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে হতে পারে।
শতভাগ মালিকানা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি আমেরিকান লাইফ ইন্স্যুরেন্স (অ্যালিকো) ১৯৬০ সালে বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করে। অ্যালিকো বাংলাদেশে বেশ সফলভাবে ব্যবসা করে যাচ্ছে।
আইডিআরএ সূত্রে জানা যায়, অ্যালিকো একাই জীবনবিমা খাতের চারভাগের একভাগ ব্যবসা করছে। ২০০০-২০১৩ সাল পর্যন্ত গত ১৪ বছরে অ্যালিকো বাংলাদেশ থেকে মুনাফা করেছে ৭৬২ কোটি ৯১ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
এ অবস্থায় আরো বিদেশি বিমা কোম্পানি এ দেশে ব্যবসা চালু করলে দেশীয় কোম্পানিগুলোর ব্যবসা কমে আসবে— এমনটাই মনে করছেন অনেকে।
তবে ভিন্ন মত আইডিআরএ সদস্য জুবের আহমেদ খানের। তিনি বলেন, ‘বিদেশি কোম্পানি দেশে এলে দেশের অর্থনীতির জন্য যেমন ভালো, তেমনি কোম্পানিগুলোর জন্যও দিকনির্দেশনা আসবে। কোম্পানিরগুলো একদিকে খরচের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না, আবার আয়ও বাড়াতে পারছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের নিয়ম করেও ঠিক করা যাচ্ছে না। বিদেশি কোম্পানি একটি সিগনাল হিসেবে কাজ করবে। বাংলাদেশে বড় অঙ্কে বিমা খাতে বিনিয়োগ করা যায়। কিন্তু দেশীয় কোম্পানিগুলো সেভাবে পারছে না।’
জুবের আহমেদ বলেন, দেশে এক সময় সরকারি ব্যাংক ছিল। তারপর বেসরকারি ব্যাংক আসে। এখন সেই একই বাজারে বিদেশি অনেক ব্যাংকও কাজ করে মুনাফা করছে।
আইডিআরের আরেক সদস্য আবদুল কুদ্দুস বলেন, ‘দেশের উন্নতি, ব্যাংকিং খাতের সম্প্রসারণ ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান বাড়ছেই। সে তুলনায় বিমা খাত এগোয়নি।’
দেশীয় বিমা খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে আবদুল কুদ্দুস বলেন, ‘আইন মেনেই বিদেশি কোম্পানিকে ব্যবসার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। বিকাশমান বিমা খাতকে আরো সম্প্রসারিত করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিতে চাই। বিদেশি কোম্পানিগুলো এলে একদিক দিয়ে দেশি কোম্পানির প্রতিযোগিতা বাড়বে। তবে দেশি কোম্পানিগুলোও ব্যবসা সম্প্রসারিত করবে।’
এ প্রসঙ্গে অ্যালিকো মুখপাত্র ও জনসংযোগ বিভাগের প্রধান মো. মুনিরুল ইসলাম বলেন, ‘বিমা একটি সেবামূলক ও প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসা। সর্বোচ্চ সেবা চায় গ্রাহকরা। যে কোস্পানিগুলো বাজারে আসছে তারা খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান। এটা গ্রাহকদের জন্য সুখবর। অনেকের মধ্যে ভালো পণ্যটি বাছাই করতে পারবে। নতুন কোম্পানি বাজারে এলে প্রতিযোগিতা আরো বাড়বে। দেশীয় ছোট ও নতুন অনুমোদন পাওয়া কোম্পানির ব্যবসা করা কঠিন হবে। তবে বীমা খাতে উন্নতি হবে।’
এনআরবি গ্লোবাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল বাশার আকন্দ বলেন, ‘গত কয়েক বছরে অনুমোদন পাওয়া দেশীয় বিমা কোম্পানিগুলোর ব্যবসা ভালো হচ্ছে না। অনেকে শুরুতে ধুমধাম করে আত্মপ্রকাশ করলেও কিছুদিন পরই চুপসে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বিদেশি কোম্পানি এলে তারা আরো প্রতিযোগিতায় পড়বে, তাতে কোনো সংশয় নেই। নতুন কোম্পানির প্রোডাক্ট, পলিসির ওপর ভিত্তি করে দেশের কোম্পানি না সাজাতে পারলে অনেকে (প্রতিষ্ঠান) হারিয়ে যাবে। তবে দেশীয় বিমা কোম্পানিগুলো চাপ সামাল দিতে পারলে দীর্ঘমেয়াদে সুফল পাবে।’
প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. মরতুজা আলী বলেন, ‘বিমা কোম্পানি চালুর কয়েক বছরে যারা গ্রাহকদের কাছে বিশ্বস্ত হতে পারে তারাই সফল হবে। বাংলাদেশে বিমা বাজারের তুলনায় আমরা এখনো অনেক ছোট। বিদেশি কোম্পানি এলে বিনিয়োগ বাড়বে, নতুনত্ব আসবে। গ্রাহকরা নতুন সেবা পাবে। পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে দেশীয় কোম্পানিগুলোও এগিয়ে যাবে।
আইডিআরএর বিধান মতে, বিদেশি কোম্পানি বিমা ব্যবসা করার চূড়ান্ত অনুমোদনের তিন বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে হবে। পরিশোধিত মূলধন হতে হবে ১০০ কোটি টাকা। প্রথমদিকে বিদেশি উদ্যোক্তারা শতভাগ মালিকানা বিনিয়োগ করতে চাইলে ৬০ শতাংশ বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়। তারপর বিদেশি উদ্যোক্তার সর্বোচ্চ মালিকানা থাকবে ৬০ শতাংশ— এমন শর্তারোপ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ‘বিমাকারীর নিবন্ধন প্রবিধানমালা’ নামের একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে।