লাখপতির গল্প
শাড়িতে ঐতিহ্য এনে দ্রুত হাঁটছে আফসানার ‘গুটিপোকা’
ভাবুন তো, বাংলাদেশের সুন্দর আর্কষণীয় স্থান বা ঐতিহ্যগুলো আপনার শাড়িতে ফুটে উঠেছে? সেই শাড়ি পরার পর আপনার মনোভাবে কী বার্তা ঝলমল করবে? এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগ, কেনারও ঝক্কি নেই। ঘরে বসে অর্ডার দিলেই পৌঁছে যাবে আপনার দোরগোড়ায়। হ্যাঁ, শাড়িতে ঐতিহ্য এনে লাখপতি বনে গেছেন উদ্যোক্তা আফসানা সুমী।
আফসানা বাংলাদেশের বিভিন্ন ভ্রমণস্থল, যেমন—নাফাখুম, সেন্টমার্টিন, সুন্দরবন, সাঁতলা বিল নিয়ে কাজ করছেন। এ ছাড়া ঋতুকেন্দ্রিক কাজ, বিভিন্ন গান, উপন্যাস, কবিতাকে থিম ধরে কাজ করছেন। দেশি ফুল-পাখি শাড়ি ও অন্যান্য পোশাকে তুলে আনেন। আর এতেই হু হু করে বাড়তে থাকে তাঁর পণ্যের কদর। বনে যান লাখপতি। এখন সফল উদ্যোক্তা ।
কথাগুলো যতটা সহজে বলা হলো, শুরুর পথ এতটা মসৃণ ছিল না। এনটিভি অনলাইনকে শুরু থেকে সাফল্যের গল্প শুনিয়েছেন উদ্যোক্তা আফসানা সুমী।
থিম নিয়ে কাজ করে বেশ পরিচিতি অর্জন করেছে আফসানা সুমীর উদ্যোগ ‘গুটিপোকা’। কাজের ক্ষেত্রে লক্ষ্য ধরে এগোচ্ছেন বলেই সাড়া পাচ্ছেন। অনেকে আবার তাঁদের পছন্দের থিম জানিয়ে শাড়ি নকশা করতে বলেন। ছেলেবেলার কোনো স্মৃতি বা গল্প জানান। আফসানা সেই গল্প পোশাকে গাঁথেন।
তো, কেমন আছেন আফসানা ও তাঁর গুটিপোকা? এমন প্রশ্নের জবাবে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘বেশ ভালো আছি। আঁকাআঁকি আমার শখ ও পেশা। ব্যস্ততা একে ঘিরেই। গুটিপোকা এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যা পরিধানযোগ্য চিত্রকর্ম বা ওয়্যারেবল আর্ট নিয়ে কাজ করে। বাংলাদেশে হাতেগোনা যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এই শিল্পের ধারাকে প্রতিনিধিত্ব করছে, গুটিপোকা তার একটি।’
গত ২৩ জানুয়ারি ছিল গুটিপোকার সপ্তম জন্মদিন। অর্থাৎ আফসানার গুটিপোকার সাত বছরের পথচলা। তাঁর অনুপ্রেরণা বিবি রাসেল। তাঁর উদ্যম, লড়াই করার মানসিকতা, শক্তি—এ সবকিছু পথ দেখিয়েছে আফসানাকে। আর মা ছিলেন অন্যতম শক্তির উৎস। তিনি নিজেও উদ্যোক্তা। সব সময়ই সাহস জুগিয়েছেন।
তবে আফসানার চোখে স্বপ্ন পূরণের প্ল্যাটফর্ম উই (উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম)। তাঁর কথায়, ‘উই একটি জাগরণের নাম, বিপ্লবের নাম। দেশি পণ্য নিয়ে আমিসহ অনেকেই দীর্ঘদিন স্ট্রাগল করে যাচ্ছিলাম। বাজারে বিদেশি পণ্যের আধিপত্য এতটাই ছিল যে দেশি পণ্য মানুষের মন ও মগজে জায়গা করতে পারছিল না। রাজিব আহমেদ স্যার আমাদের উদ্যোক্তাদের ক্রমাগত আরও আকর্ষণীয়ভাবে দেশি পণ্য উপস্থাপনে উৎসাহ দেন। ব্যাপক প্রচারণা ও উচ্চ মানের কাস্টমার সার্ভিসে জোর দেন তিনি। বারবার বলেন, নিজের পণ্যকে জানতে ও নির্ভরযোগ্য কনটেন্ট তৈরি করে পণ্যের পরিচিতি বাড়াতে। পাশাপাশি পারসোনাল ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে ক্রেতার ভরসা অর্জনের ওপরও জোর দেন তিনি। অন্যদিকে, নাসিমা আক্তার নিশা আপু বিভিন্ন ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেন। উই থেকে অসংখ্য ট্রেনিং ফ্রিতে বা নামমাত্র মূল্যে করেছেন নারী উদ্যোক্তারা। সার্টিফিকেটও অর্জন করেছেন।’
আফসানা জানান, তাঁর পরিবারের প্রত্যাশা ছিল ব্যাংকে চাকরি করবেন। ব্যবসা নিয়ে শুরুতে মন খারাপ করলেও কখনো বাধা দেয়নি কেউ। এখন অবশ্য সবাই গর্ববোধ করে গুটিপোকার সাফল্য নিয়ে।
আফসানা আরও জানান, করোনার সময় ব্যবসা বন্ধের উপক্রম হয়েছিল। কীভাবে গুটিপোকা টিমের খরচ চালাবেন, স্পেসের ভাড়া কীভাবে দেবেন—এমন অনেক সংকট মনচাড়া দিয়েছিল। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আগে থেকে কিছু ম্যাটারিয়াল কিনে রেখেছিলেন, সেটা বোঝা লাগছিল তাঁর। কিন্তু সেটাই আশীর্বাদ হয়ে গেল। উই-তে দেশি পণ্যের জোয়ারে যোগ দিলেন, নতুন নতুন শাড়ি আঁকলেন আর একে একে বুকিং হয়ে গেল। এভাবেই জিতে গেলেন অস্তিত্বের লড়াইয়ে। আর এর কৃতিত্ব উই-কে দিলেন আফসানা।
আফসানার মূল ফোকাস শাড়ি হলেও কামিজ, ওড়না, পাঞ্জাবি, বাচ্চাদের পোশাক, থিমভিত্তিক পারিবারিক পোশাক, টাই, জুতা, ব্যাগ, গহনা নিয়েও কাজ করেন। তিনি আরও জানান, সব সময় ভালো ম্যাটারিয়াল কেনেন। খুঁজে খুঁজে সবচেয়ে ভালো মসলিন, সিল্ক, এন্ডি কেনেন শাড়ির জন্য। নতুন কোনো কাপড়ে কাজ করলে আগে নিজেরা ব্যবহার করে দেখেন। রঙের স্থায়িত্ব পরীক্ষা করেন। শুধু পণ্য তৈরি নয়, ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়ার পর অভিযোগ থাকলে, সেটি নিয়েও কাজ করেন আফসানা।
আফসানার লেখাপড়া হিসাববিজ্ঞানে হলেও আঁকাআঁকি পছন্দ তাঁর। বলেন, ‘আমি ইডেনের ছাত্রী, মাস্টার্স করেছি একাউন্টিংয়ে। আমি ছবি আঁকতে ভালোবাসি, ছবি আঁকতে তো অবশ্যই দক্ষ। একটা প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছি, সেই হিসেবে ব্যবস্থাপনায়ও দক্ষতা আছে। পণ্যের ছবি তুলি, কনটেন্ট লিখি, ভিডিও তৈরি করি। উদ্যোক্তাকে অসংখ্য দক্ষতা নিয়ে চলতে হয়, ১০ জন কর্মীর কাজ একা করতে হয়।’
আফসানার আত্মবিশ্বাস তাঁকে সফল করেছে। তিনি জানেন, নিজের সবল দিক কোনগুলো। আর সেগুলোই প্রস্ফূটিত করে জীবনে কাজে লাগান। তো লাখপতি হতে পেরেছেন? আফসানার উত্তর, ‘জি, লাখপতি হতে পেরেছি। শিগগিরই সেল ১০ লাখের ঘরে যাবে। তবে এটা সেল, মুনাফা নয়। অনেক ক্রেতা পেয়েছি, হ্যান্ড পেইন্টের বাজার বড় হয়েছে—এই শান্তি মনে।’
আফসানার গুটিপোকায় চিত্রশিল্পী আছেন পাঁচ জন। তিনি নিজেও আঁকেন। তাঁর ইচ্ছে, বাংলাদেশের সুন্দর সুন্দর সব জায়গা আঁকতে চান, ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর ছবিও নিয়ে আসতে চান শাড়িতে। গুটিপোকা হবে বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি, এ আশা আফসানার।