প্রতিক্রিয়া
স্ত্রীর চোখ উৎপাটন ও নারীর ক্ষমতায়ন
‘টঙ্গীর গৃহবধূ ৩৫ বছর বয়সী শিউলীর দুই চোখ ধারালো ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলে নিয়েছে পাষণ্ড স্বামী। শুধু চোখই নয়, চোখের দুটি পাতাও কেটে নেওয়া হয়েছে।’ কিংবা ‘স্বামী চাকু দিয়ে দুই চোখ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলে নিয়েছে স্ত্রীর।’ গত ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের প্রধান সংবাদপত্রগুলো এভাবেই সংবাদ ছেপেছে টঙ্গীতে স্বামী কর্তৃক স্ত্রী নির্যাতনের চাঞ্চল্যকর (!) ঘটনাটি। স্ত্রীর অপরাধ, সে তার আগের স্বামীর কাছ থেকে দেনমোহর বাবদ প্রাপ্য সম্পত্তি এনে বর্তমান স্বামীকে দেয়নি। আমরা উন্নয়নের যতই কীর্তন গাই না কেন কিংবা গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে যতই জিগির করি না কেন, সামাজিকভাবে খুব বেশি আমরা অগ্রসর হইনি। এ ধরনের ঘটনা আমাদের সমাজে নারীর অবস্থানকে স্পষ্ট করে। নারী নির্যাতন, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, যৌন হয়রানি, নারীর অধস্তনতা প্রভৃতির বিপরীতে নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর সক্ষমতা বৃদ্ধি, নারীর সমানাধিকার, নারীর পেশাগত উন্নয়ন, নারী শিক্ষার প্রসার প্রভৃতি সামাজিক ও রাজনৈতিক ডিসকোর্সকে আবারো নতুন করে পুনর্ভাবনার মওকা তৈরি করে দেয়। কেননা, সাময়িক বিরতি দিয়ে এ রকম বর্বর ঘটনা আমাদের সামনে এমনভাবে হাজির হয়, যা আমাদের ‘নারী উন্নয়ন’কেন্দ্রিক তৃপ্তির ঢেঁকুরকে নতুন করে প্রশ্নের মুখোমুখি করে। অমর্ত্য সেনের দেওয়া সার্টিফিকেট—মানব উন্নয়নের সূচকে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার গুণগান তখন লজ্জায় পড়ে যায়! কেননা, আমরা এখনো নারীকে ‘মেয়ে মানুষ’ হিসেবে বিবেচনা করি; ‘মানুষ’ হিসেবে নয়।
শিউলীর ঘটনা সত্যিকার অর্থে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এ রকম ঘটনা সারা বছর ধরেই নানা তরিকায় নানা রূপে নানা জায়গায় নিত্য সংঘটিত হচ্ছে। আমাদের দেখা না-দেখার ভুবনে তারা নিত্য আসা-যাওয়া করে। কেননা, বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা প্রধানত পেট্রিয়ার্কাল বা পুরুষতান্ত্রিক এবং সে কারণেই এর চরিত্র পুরুষাধিপত্যবাদী। আর এ পুরুষাধিপত্যবাদী সমাজ-কাঠামোই নারীর অবস্থান গবেষণা করে নৃবিজ্ঞানী সারা সি হোয়াইট রাজশাহীর কুমিরপুর (লেখিকার দেওয়া ছদ্মনাম) গ্রামের ওপর লিখিত তাঁর বিখ্যাত ‘এথনোগ্রাফি আর্গুইং উইথ দ্য ক্রোকোডাইলস : জেন্ডার এ-ক্লাস ইন বাংলাদেশ’ (১৯৯২) গ্রন্থে প্রতীকী উপস্থাপনায় দেখিয়েছেন, এই গোটা সমাজটাই হচ্ছে আসলে একটা পুকুরের মতো আর এ সমাজে বসবাস করা পুরুষ মানুষ হচ্ছে এক-একটা কুমির। আর সমাজের নারীরা এসব কুমিরের সঙ্গে যুদ্ধ করে পুকুরে বাস করে। যাকে বাংলার জনপ্রিয় প্রবাদবাক্যে বলা হয় ‘জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে যুদ্ধ’। এটা রূপকার্থে সমাজে বসবাসরত নারী-পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান এক ধরনের অসম-ক্ষমতা এবং নারীর ওপর পুরুষের একচ্ছত্র আধিপত্যবাদ বা আধিপত্যবাদী সম্পর্ককেই নির্দেশ করে। অতএব, সমাজের কুমিররা নিজের মতো করে নারীর ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করবে, নারীকে ইচ্ছামতো নির্মাণ করবে, নারীকে নারীর স্বাধীন ইচ্ছার বিরুদ্ধে পরিচালিত করবে, নারীকে ভোগ করে, নারীকে কাপড় পরাবে, আবার প্রয়োজনমতো কাপড় খুলবে। এটাই কুমিরের সঙ্গে পুকুরের জলে বাস করার নিয়তি। আর এ কারণেই স্বামী জুয়েল হাসান স্ত্রী শিউলীর চোখ ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলে ফেলতে পারে। ধারালো ছুরি দিয়ে চোখের পাতা কেটে ফেলতে পারে। কেননা, জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে ঘর-সংসার করলে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের শহুরে নাগরিক মধ্যবিত্তের সুশীল ব্যবস্থার মধ্যেও ‘কুমির-তত্ত্বের’ বিস্তর নজির আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এক শিক্ষিকার দুটি চোখই উপড়ে ফেলেছিল তারই উচ্চশিক্ষিত স্বামী। টঙ্গী কিংবা ঢাকা, শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত, সব রসুনের তলা একই। সরকারি হিসেবেও ঘটনার অন্যথা নাই। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বিবিএসের একটি জরিপ (ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন সার্ভে ২০১১) বলেছে, ‘শারীরিক নির্যাতনের শিকার নারীরা মাত্র অর্ধেক চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ পান। এক-তৃতীয়াংশ নারীই স্বামীর ভয়ে বা স্বামী সম্মতি না দেওয়ায় চিকিৎসকের কাছ পর্যন্ত যেতেই পারেননি।’ তাই শহুরের কুমিরের কাহিনী আমাদের অদেখা ভুবনের না দেখা বিষয় হয়ে থাকে। কিন্তু শহর কিংবা গ্রাম, নগর কিংবা গ্রামীণ, কেন্দ্র কিংবা প্রান্ত, জল আর কুমিরের মেটাফোর কমবেশি মূলত একই। সবার ক্ষেত্রে এ কথা সত্য না হলেও অনেক ক্ষেত্রেই সত্য।
বাংলাদেশে নারী নির্যাতন এবং নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলছে। সংবাদপত্রের হিসাব অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ৯৩ হাজার ৬৮৬টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। কেবল ২০১৩ সালেই সংঘটিত হয়েছে চার হাজার ৭৭৭টি নারী নির্যাতনের ঘটনা (দেখুন দৈনিক ইত্তেফাক, ০২/০১/২০১৪)। ২০১৪ সালে সংঘটিত হয়েছে চার হাজার ৬৬৫টি নারী নির্যাতনে ঘটনা, যার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৯৩৯টি; আর ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৯৯ জনকে (দেখুন দৈনিক সমকাল, ০১/০১/২০১৫)। তাই নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে রাজধানীর কোনো শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে মিনারেল ওয়াটারে গলা ভিজিয়ে আমরা যতই সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি না কেন, বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় নারী অবস্থানের এখন পর্যন্ত তেমন একটা ইতিবাচক-গুণগত পরিবর্তন হয়নি। তা ছাড়া বাইরের দৃশ্যমান নারী উন্নয়নের নানা সাইনবোর্ড থাকলেও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘরের ভেতরেই ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিবিএসের জরিপ রিপোর্ট অনুযায়ী (ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন সার্ভে ২০১১), ‘দেশের বিবাহিত নারীর ৮৭ শতাংশই স্বামীর মাধ্যমে কোনো না কোনো সময়ে, কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা স্বামীর মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতন ভোগ করেছেন, ৩৬ শতাংশ যৌন নির্যাতন, ৮২ শতাংশ মানসিক এবং ৫৩ শতাংশ নারী স্বামীর মাধ্যমে অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তা ছাড়া এসব নারীর ৭৭ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা নিয়মিতভাবে একই ধরনের নির্যাতন ভোগ করেছেন। বড় অংশের নারীকেই তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামীর সঙ্গে যৌনসম্পর্ক গড়তে বাধ্য হতে হয়েছে।’ তাই আমরা যা দেখি, তা অদেখা ভুবনের সামান্যকেই প্রতিবিম্বিত করে। শিউলীর ঘটনা আমাদের সেই না দেখা জগতের অদেখা ভুবনের সামান্য নমুনা হাজির করে।
বাংলাদেশের সর্বত্র এখন উন্নয়নের গুণকীর্তন। বিশেষ করে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে বেশ এগিয়ে যাচ্ছে; গত এক দশক প্রবৃদ্ধির হার ৬-এর ওপরে ধরে রাখা এবং চলতি বছরে সেটা ৬.৫ হয়ে ওঠা, উন্নয়নের গুণকীর্তনের লিরিক। কিন্তু যে সমাজ কাঠামোগতভাবে এবং সাংস্কৃতিকভাবে ‘পুরুষশাসিত’, সেখানে কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়ন সমাজে বিদ্যমান লৈঙ্গিক সম্পর্ক (জেন্ডার রিলেশনস) এবং সম্পর্কের লৈঙ্গিক অসমতাকে (জেন্ডার ইনইকুয়ালিটিকে) বিনির্মাণ করে না। এবং বিদ্যমান লৈঙ্গিক অসমতার কোনো গুণগত পরিবর্তন ও রূপান্তর করে না। তাই আজ ২০১৫ সালে এসেও, ২৭ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের দেশ হয়েও, পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তর তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হয়েও, নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের জাতে উঠেও, সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়, ‘স্ত্রীর দুই চোখ উপড়ে নিল পাষণ্ড স্বামী’। কেননা, এ স্বামীরাই শাসন করে সমাজ ও সমাজের পরম্পরা। নিয়ন্ত্রণ করে প্রাইভেট ও পাবলিক পরিসরের ক্ষমতা ও ক্ষমতা-কাঠামো। আমাদের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের জোয়ারের তলে তলে যে একটা কুৎসিত ভাটার অস্তিত্ব সদা বহমান, এটা তারই নগদ নজির। সমাজের গুণগত রূপান্তর না ঘটিয়ে কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়ন যে সমাজের মানুষের মধ্যে, নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো মর্যাদার সম্পর্ক তৈরি করে না, এটা তারই প্রমাণ।
এ ঘটনা আমাদের এ সিদ্ধান্ত অনুমানে বাধ্য করে, সনাতনভাবেই বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় বিদ্যমান পুরুষাধিপত্যের যে প্রবল প্রভাব, সেখানে নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো খুব একটা উল্লেখযোগ্য পরিমাণের পরিবর্তন হয়েছে, এ কথা বলা যাবে না। এ দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী কিংবা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের নারীর উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি থাকলেও নারীরা সমাজের এখনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে খুব উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভূমিকা রাখছে, এ রকম কোনো গবেষণা তথ্য নেই। কেবল ঢাকার চরিত্র দিয়ে বাংলাদেশকে বিচার করা যাবে না। নারী শিক্ষার হার বেড়েছে, জিপিএ ৫-এর ভাগাভাগিতে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরা সমানতালে ভাগ বসাচ্ছে; চাকরিজীবী হিসেবে নারীর সংখ্যা বেড়েছে; পেশাজীবী হিসেবে নারী এগিয়ে আসছে; নারী এভারেস্ট জয় করেছে; এতে করে রাজধানীকেন্দ্রিক নারীর দৃশ্যমানতা বেড়েছে। কিন্তু নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে, এ কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। শিউলী হয়তো আর কোনো দিন দেখতে পারবে না; কেননা তার দুটি চোখই উপড়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের তো দুটি চোখই আছে। আমরা কি আসলে দেখতে পাই? বা ভবিষ্যতে কি দেখতে পাবো?
লেখক : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।