প্রতিক্রিয়া
এই সমাজই ঐশীকে তৈরি করেছে
মা-বাবাকে হত্যার দায়ে আলোচিত ঐশীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে, বলা হয়েছে ঐশী ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে, এও বলা হয়েছে যে সুস্থ্য মস্তিষ্কে ঐশী স্বীকার করেছেন যে পরিকল্পিতভাবে কফির ভেতরে চেতনানাশক ঔষধ খাইয়ে তাঁর মা-বাবাকে হত্যা করেছেন। আর হত্যার পর পালিয়ে থাকতে তাঁকে তাঁর বন্ধু রনি সহযোগিতা করেছিলেন। আদালতে রায় বলে যে তার আরেক বন্ধু জনি হত্যা কিংবা সহযোগিতা কোনোটিই করেননি। কারণ- আদালতের রায়ে, রনিকে দুই বছর কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয় আর খালাস পান জনি।
১৫৪ ধারার জবানবন্দিতে ঐশী যখন খুনের ঘটনা স্বীকার করেন তখন তিনি সুস্থ থাকলেও যখন খুন করেন তখন কি সুস্থ ছিলেন? এমন কোনো রিপোর্ট কি আছে যে, ঐশী ওই ঘটনার সময় একেবারেই নেশাগ্রস্ত ছিলেন না? কেন ঐশী তাঁর মা-বাবাকে অমানবিকভাবে হত্যা করেছেন? সেই কারণ খুঁজে যদি ব্যবস্থা না হয়, তাহলে তো একটা ঐশীর ফাঁসির পরও এমন আরো অনেক ঐশী এই সমাজে আবারও তৈরি হতে পারে। ঐশীর মতো নতুন কোনো চরিত্র যে আর তৈরি হবে না সেটা যেমন বলা যায় না, তেমন মাদকের এই মরণ ছোবল হয়তো আরো অনেক ঐশীকে এভাবে শেষ করে সমাজকে আরো বেশি ক্ষয়িষ্ণু করে দিতেই পারে।
যদি বলা হয়, ঐশী পরিকল্পিতভাবে ঠান্ডা মাথায় তাঁর মা-বাবাকে হত্যা করেছেন, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে— কী এমন নেপথ্যের ঘটনা ছিল যে দুজন মানুষকে হত্যা করেছে একজন এবং তা পরিকল্পিতভাবে? কী এমন ঘটনা বা স্বার্থের দ্বন্দ্ব ছিল যে ঐশী সুস্থ মস্কিষ্কে তাঁর মা-বাবাকে হত্যা করবেন? এই খুনের পেছনে কি আর কারো কোনো দায় নেই? কিংবা এজন্য কি শুধু ঐশীকেই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে?
আর ঐশীর সার্টিফিকেট বয়স ও ডিএনএ টেস্ট রিপোর্টের মধ্যে পাথর্ক্য রয়েছে। বয়স এবং ঘটনার প্রেক্ষাপট নিয়ে বিতর্ক আছে, থাকতেই পারে। আদালতের এই ফাঁসির রায়ের বিবেচ্য ছিল যে ঐশী প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন, আরেকটি বিবেচ্য বিষয় ছিল তিনি সুস্থভাবেই স্বীকার করেছেন হত্যার কথা। কিন্তু সামান্য কয়েক মাস বেশি হলেই ফাঁসি হবে আর ওই কয় মাস কম থাকলে ফাঁসির হাত থেকে বেঁচে যেত ঐশী এমন যদি হয়, তাহলে মাত্র কয়েক মাসের এই পার্থক্যে রায়ের এত বড় পাথর্ক্য কতটা গ্রহণযোগ্য?
কিন্তু ইয়াবার মতো ভয়াল নেশার সান্নিধ্য তো ঐশী প্রকৃতি থেকে পাননি। দামি দামি নেশাদ্রব্য তো ঐশী তাঁর নিজের উপার্জনের টাকা দিয়ে কিনতেন না। এমন কি ঐশী যে নেশাগ্রস্ত এবং এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের উৎস যে ছিল তাঁর মা-বাবা সেই কথাও তো অনেকেরই জানা। ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে...’ কিংবা ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সবর্নাশ’ ছোট বেলা থেকে শিখে আসা এমন প্রবাদ প্রবচনগুলো কি ভুল?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জঘন্যতম ও নৃশংস এমন অপরাধ যখন তিনি করেন তখন কতটা সুস্থ ছিলেন ঐশী? নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের জন্য কি শুধু ঐশীই অপরাধী? আজকের ঐশী তো সেই ঐশী নন যে ছোট থেকে বড় হয়েছেন মা-বাবার স্নেহ আর আদর আহ্লাদে। তাহলে ধীরে ধীরে নেশাগ্রস্ত ও মানসিক বিকারগ্রস্ত ঐশী হওয়ার ক্ষেত্রে কে বা কারা তাঁকে সহযোগিতা করেছিল? সেগুলো কি তাহলে নেপথ্যেই থেকে যাবে?
ঐশীর ক্ষয়িষ্ণু সমাজ, ঘুনে ধরা নৈতিকতা আর মূল্যবোধ বিবর্জিত পারিপার্শ্বিকতা এবং বিকৃত সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া কি তাকে খুনি ঐশী করে তোলেনি? আর যদি তা হয় তাহলে কেন শুধু ঐশীর ফাঁসি হবে? কমপক্ষে ঐশীকে ভালো করার কোনো দায় কি কারো নেই? রাষ্ট্র, সমাজ আর পরিবারে এমন ঐশীর জন্ম যেন আর না হয়, সেজন্য কি রায় হবে? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর কি আছে আইনের শাসনের এই সমাজের কাছে?
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী