প্রতিক্রিয়া
ঈশ্বর থেকে পাওয়া মেয়েটি এখন কনডেম সেলে, একা
মেঘনাদ বধ কাব্য পাঠে পরস্ত্রী অপহরণকারী রাবণের প্রতি ঘৃণা নয়, মনের গহিনে জেগে ওঠে কষ্টের বিষণ্ণ মেঘ। রাক্ষসরাজ রাবণের পরাজয়ে বেদনার হিমবাহ আচ্ছন্ন করে যায় মনকে। আজ তেমনি এক অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে মন। সকাল থেকেই টিভিগুলো সরব হয়ে উঠেছিল। স্ক্রলগুলো যুদ্ধবাজ বিমানের মতো ছুটছিল এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। ঐশীর মামলার রায় হবে আজ। দুপুর শেষ হতে না হতেই সব খবর ছাপিয়ে বড় বড় অক্ষরে স্ক্রলে ভেসে উঠল, বাবা-মাকে হত্যার দায়ে ঐশীর ফাঁসির আদেশ। তবে মনের আঙিনায় ঐশীর জন্য নেমে এসেছিল বেদনার বিষণ্ণ মেঘ। এই বেদনা জাগা অপরাধ কি না জানি না। শুধু জানি, বেদনা জেগেছিল।
ঐশী! যে তার জন্মদাতা বাবা, জন্মদাত্রী মাকে একসঙ্গে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল তার জন্য বেদনা! তার ফাঁসির আদেশ শুনে স্বস্তি নয়, তার জন্য মনের গহিনে জমে ওঠে কষ্টের পাথর। কেন?
একটি মেয়ে, কতই বা বয়স ছিল। হাতের আঙুলে গোনা যায় এমন বয়স। জীবনের ভোরটাই শুধু দেখেছে সে। কেবল হামাগুড়ি দিয়েছে জীবনের বারান্দায়। সেই জীবনটা কত যন্ত্রণার সমুদ্রে ডুবে আছে আজ। কত আত্মগ্লানি, কতশত অপবাদ, কত নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতায় পূর্ণ জীবন। হয়তো আর কয়েক দিন, কয়েক মাস পরেই নিভে যাবে সে জীবন। অথচ সুবর্ণ আলোয় সে ভরিয়ে দিতে পারত আমাদের চারপাশ। হয়নি, পারেনি সে। মেয়েটির বাবা-মা বড় নিবিড় ভালোবাসায় তাকে পৃথিবীতে এনেছিল। ভালোবেসে নামটাও রেখেছিল ঐশী। যার অর্থ ঈশ্বর থেকে পাওয়া। সেই ঐশী একসঙ্গে খুন করল জন্মদাতা বাবা, জন্মদাত্রী মাকে। কত ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা। কী নির্মম সন্তান। শুধু এটুকু ভাবতে পারলে মন্দ হতো না। কিন্তু কোথায় যেন কথা থাকে, কথা আছে।
ঐশীর বাবা পুলিশের বড় কর্মকর্তা ছিলেন, বিত্ত বৈভবের কমতি ছিল না। তাঁর সব ছিল, তবে কেন জানি মনে হয় তিনি জন্মদাতা ছিলেন সত্য, বাবা হতে পারেননি। বাবা হয়ে ওঠা কষ্টের, সবাই পারে না। ঐশীর বাবাও পারেননি। অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতায় পূর্ণ একটি পরিবারের সামনে অনেকগুলো পথ খোলা থাকে। নয়তো পথগুলো এমনিতেই খুলে যায়। সে পথের কোনোটায় থাকে আলো, আর কোনোটায় থাকে নিকষ আঁধার। সন্তানদের সে পথ চিনিয়ে দিতে হয়। হাত ধরে নিয়ে যেতে হয় জীবনের সবুজ প্রান্তরে। জীবনের আকাশটার রয় চেনাতে হয়। নদী, মাঠ, দোয়েলের গান শোনাতে হয়। ছায়াময় অভয় অন্তর দিয়ে সন্তানকে আগলে রাখতে হয়। ঐশীর বাবা এসব পারেননি। ঐশীর মা, তিনি কেমন ছিলেন তাও জানি না। তবে এটুকু বুঁঝি, বুকের গহীনে যতটুকু উষ্ণতা থাকলে একটি ছোট্ট পাখি ডানা ঝাপটাতে পারে, নীল আসমানে উড়ে বেড়াতে শেখে সেই উষ্ণতা ঐশীর মায়ের বুকে ছিল না ।যদি তাই থাকত তা হলে একটি ছোট্ট শিশুরমনে পিতৃঘাতী পশু বাসা বাঁধতে পারত না। কোনো দিনই না।
অর্থবিত্তের চার দেয়ালে ঐশী ছিল একা, নিঃসঙ্গ এক অবোধ শিশু। পথ চিনতে না পারা এক শিশু। ঐশী ঘাতক হয়েছে সত্য। তাই বলে একদিনে, একপলকে ঘাতক হয়নি। একদিন, দুদিন, মাস, বছর পেরিয়ে শিশু ঐশী আজকের “খুনি; ঐশীতে বদলে গেছে। সে বুঝতে শেখেনি, কখন, কীভাবে তার ছোট্ট জীবনপাত্রটি বিষে বিষে টইটম্বুর হয়ে উঠেছিল। পিতৃ-মাতৃঘাতী হিংস্র দানবটি কখন তার অন্তরে বেড়ে উঠেছিল। শ্বাপদসংকুল অন্ধকার পৃথিবীতে কেউ তাকে ছায়া দেয়নি, পথ দেখায়নি। অর্থ-বিত্তের চার দেয়ালে ঐশী ছিল নিঃসঙ্গ মানুষ। এক নিঃসঙ্গ অবোধ শিশু। তার সামনে ছিল না কোনো বাতিঘর। কেউ তাকে পথ চিনতে শেখায়নি। উদ্যানে গোলাপ চারা বুনলেই গোলাপ ফোটে না। ঐশীর বাবা-মায়েরা শুধু চারা বুনে গেছেন। পরিচর্যা করেননি। একটু একটু করে গোলাপ গাছ বড় হয়েছে,তাতে কাঁটা গজিয়েছে,গোলাপ ফুলটা ফোটেনি।
ঐটুকু মিষ্টিমুখ মেয়ে, যার সামনে আজ জীবনের অনন্ত দিগন্ত উন্মুক্ত অবারিত থাকবার কথা, সম্ভাবনার সিংহদুয়ারে আনন্দের ঘণ্টাধ্বনি বাজবার কথা,সেই মেয়েটি এখন কনডেম সেলে, একা। আইনি লড়াইয়ে নিঃসঙ্গ ছোট্ট মেয়েটি আজ সমাজ সংসার থেকে বহু দূরে, বন্ধুরা নেই, সহপাঠীরা নেই। স্বজনরা ঘৃণার আগুনে ঝলসে দিয়েছে তার বুক।
এই মেয়েটিকে সমাজ ঘৃণা করছে, রাষ্ট্র ফাঁসিতে ঝুলানোর আদেশ দিয়েছে। অথচ এই সমাজ তার নিঃসঙ্গতা, বাবা-মায়ের উদাসীনতা পূরণ করেছে মদ, মাদক দিয়ে। ঐশীর শহরে ফুল কিনতে বহুপথ পেরুতে হয় কিন্তু হাত বাড়ালেই মাদক মেলে। চারিদিকে মাদকের হাট বসেছে, নষ্টপথে চকমকি পাথর বসছে, অথচ গৃহকোণে নিয়ত কালসাপ ঢুকছে কেউ খেয়াল করছে না। না খেয়াল করছে বাবা, না খেয়াল করছে মা,
না খেয়াল করছে রাষ্ট্র। কেউ না।
রাবণ না হয় নিয়তির বিধানে পরাভূত হয়েছিল।আমাদের ঐশীদের নিয়তিতো বাঁধি আমরাই। আমাদের পাপের কালোপথে আমাদের ঐশীদের টেনে আনি, অসময়ে ঘুম ভাঙিয়ে বলি যুদ্ধে যা। যে যুদ্ধের অনিবার্য পরিণতি মৃত্যু কিংবা পঁচে যাওয়া।
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক