নিয়ন্ত্রণ
প্রতিক্রিয়াশীলদের কাছে নৈতিক পরাজয়
সরকারের টেলিযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন-বিটিআরসির হিসেবে, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে মোবাইল ফোন গ্রাহকের সংখ্যা ১৩ কোটিরও বেশি। মোবাইল ফোনের মতোই বাড়ছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা।বিটিআরসির তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার কোটি।সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকের ব্যবহারকারীও বাড়ছে ব্যাপক হারে। গত অক্টোবর মাস পর্যন্ত দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় কোটি। শুধু তাই নয়, অনলাইনে কেনাকাটা, বিভিন্ন বিল, শিক্ষার্থীদের বেতন ও ভর্তি ফি পরিশোধও ক্রমান্বয়ে জনপ্রিয় এবং সহজ হচ্ছে। সার্বিক বিবেচনায়, সরকারের অন্য যেকোনো সাফল্যের তুলনায় তথ্যপ্রুযুক্তি খাতে সাফল্যের পাল্লা ভারি। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে সরকারের যে প্রতিশ্রুতি, তা বাস্তবায়নে সরকার বেশ সফলতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হয়। যদিও এই ডিজিটালযাত্রা প্রায়শই প্রশ্নের মুখে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে।
১৮ নভেম্বর ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগের সব মাধ্যমই অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয় সরকার। বেলা ১২টায় সরকারের নির্দেশে এসব মাধ্যম বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করতে গিয়ে প্রায় এক ঘণ্টার বেশি ইন্টারনেট সেবাই বন্ধ থাকে।
মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের রিভিউ আবেদনের রায় ঘোষণার পর এসব সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বন্ধের নির্দেশনা জারি করা হয়। এসব মাধ্যম ব্যবহার করে যাতে কোনো ধরনের উসকানি দিয়ে অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি না করা যায়, সে জন্য এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে।
এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘জনগণের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই ফেসবুক, ভাইবারের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছে। একটি জীবনের মূল্যের চেয়ে বড় কিছু হতে পারে না।’
প্রথমে মৌখিক ও পরে লিখিত নির্দেশনার মাধ্যমে দেশের সব মোবাইল ফোন অপারেটর ও আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) অপারেটরকে সামাজিক মাধ্যমগুলো বন্ধ করতে বলে বিটিআরসি।
পরে অবশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো বাদে অন্যান্য সেবা যেমন মেইল, অনলাইন সংবাদমাধ্যম ইত্যাদি চালু হয়। সেক্ষেত্রে ইন্টারনেটের গতি ছিল অত্যন্ত কম। যে কারণে মোবাইল ফোনে অনলাইন সংবাদপত্রগুলো পড়া সম্ভব হলেও ল্যাপটপ বা ডেস্কটপে পড়া যায়নি। প্রসঙ্গত, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসেও বিএনপির অবরোধ কর্মসূচি চলার সময় ‘নিরাপত্তার’ কারণ দেখিয়ে ভাইবার, ট্যাংগো, হোয়াটসঅ্যাপ, মাইপিপল ও লাইন নামের পাঁচটি অ্যাপসের সেবা বন্ধ করে দেয় সরকার। তখন বলা হয়েছিল, বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য এসব অ্যাপস ব্যবহার করতেন।
বিগত সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালে কারফিউয়ের মধ্যে মোবাইল ফোন সেবা সাময়িক বন্ধ থাকলেও ইন্টারনেট চালু ছিল।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার সীমিত বা বন্ধ করার বিষয়ে চলতি মাসের শুরুর দিকে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নেদারল্যান্ডস থেকে ফিরে ৮ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে জঙ্গি অর্থায়নে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধরতে জটিলতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ডিজিটাল করেছি। এর শুভ ফলও যেমন আছে, খারাপ ফলও আছে। আমরা থ্রিজি ও ফোরজিতে চলে গেছি। এ কারণে জঙ্গিরা ইন্টারনেট, ভাইবার থেকে শুরু করে নানা ধরনের অ্যাপস ব্যবহার করে জঙ্গি কার্যক্রম চালাচ্ছে। সে জন্য আমাদের চিন্তাভাবনা আছে, যদি খুব বেশি ব্যবহার করে, হয়তো একটা সময়ের জন্য বা কিছুদিনের জন্য বন্ধ করে দেব। এই লিংকগুলো (জঙ্গি অর্থায়নের সূত্র) যাতে ধরা যায়।’ ১১ নভেম্বর জাতীয় সংসদেও একই ধরনের বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের কোনোভাবে সহ্য করা হবে না। কিছুদিনের জন্য হলেও এটা বন্ধ করে সন্ত্রাসীদের যাতে ধরা যায়, সে পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য এটা বন্ধ করে সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে ধরা হবে।’
তবে বাস্তবতা হলো, প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধ মোকাবিলা ও দমন প্রযুক্তি দিয়েই করা উচিত। মাথা ব্যথার জন্য প্যারাসিটামলই উপযোগী। মাথা কেটে ফেলা সমাধান নয়। তবে সাইবার অপরাধ দমনে জাতীয় টেলিকম মনিটরিং সেন্টারকে (এনটিএমসি) প্রযুক্তিগতভাবে আরো শক্তিশালী করার ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি এনটিএমসিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব বাহিনী ও সংস্থার সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম হিসেবেও তৈরি করতে হবে বলে মনে করেন তাঁরা।
কেননা নাশকতা ঠেকানোর নামে কয়েকটি অ্যাপস বন্ধ করলেও প্রযুক্তির দুনিয়ায় কোনো না কোনোভাবে সেটা ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করা যায়। কেনান প্রক্সি সার্ভার দিয়ে নানাভাবে ফেসবুক ব্যবহার করার উদাহরণও আছে।
তাই তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে অনলাইনভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত এবং বিশেষ করে কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে সেটি আদৌ খাপ খায় কি না, তা ভেবে দেখতে হবে।
উত্তর কোরিয়া, ইরান, চীন, কিউবা, মিসর, সিরিয়া, মৌরিতাস, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম সরকার বিভিন্ন সময়ে তাদের দেশে ফেসবুক বন্ধ করেছে। আবার পরে চালুও হয়েছে। কিন্তু উত্তর কোরিয়া ও ইরানে এখনো ফেসবুক নিষিদ্ধ। চীন সরকার ফেসবুক নিষিদ্ধের বিষয়টি সরাসরি স্বীকার না করলেও বলে যে, ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কঠোর নিয়ম মেনে চলতে হবে।
কিন্তু আমরা দেখেছি সম্প্রতি প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলা হলেও তাকে কেন্দ্র করে সে দেশের সরকার কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ইন্টারনেট বন্ধ করেনি। কারণ তারা জানে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ কোনো সমাধান নয়, বরং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দিলে প্রতিক্রিয়াশীলদের, অর্থাৎ যাদের ভয়ে এসব মাধ্যম বন্ধ করা হয়েছে, তাদের কাছে নৈতিক পরাজয় ঘটে।
নাশকতা ঠেকানোর নামে আমাদের সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো বন্ধ করে দিয়ে মূলত নাশকতাকারী তথা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কাছেই হার মেনেছে। বরং উচিত ছিল, এই শক্তির বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে আরো বেশি কাজে লাগিয়ে প্রতিক্রিয়াশীলদের মোকাবিলা করা।প্রযুক্তির সঙ্গে লড়াই প্রযুক্তি বন্ধ করে দিয়ে নয়। যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করা তথা এর বিরুদ্ধে উসকানি দিতে পারে বলে যে শক্তিকে সরকার ভয় পাচ্ছে, মনে রাখা দরকার সংখ্যায় তারা নগণ্য। বরং যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল এবং যে আন্দোলনের ফলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী আনতে সরকার বাধ্য হয়েছিল, সেই আন্দোলনও গড়ে উঠেছিল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের কারণেই। অথচ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, সেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমই সরকার এখন বন্ধ করে দিয়েছে নাশকতার আশঙ্কায়।
এই কিছু প্রতিক্রিয়াশীল লোকের উসকানির ভয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী পুরো জনগোষ্ঠী বঞ্চিত হবে, সেটি কোনো যুক্তি হতে পারে না।বরং মনে রাখা দরকার, রাজনীতির সংকট মোকাবিলা করতে হয় যেমন রাজনীতি দিয়ে, গণতন্ত্রের সংকট উত্তরণ ঘটাতে হয় আরো বেশি গণতন্ত্র দিয়ে, তেমনি তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারও ঠেকাতে হবে তথ্যপ্রযুক্তি দিয়ে।সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ইন্টারনেট বন্ধ করে নয়। এ জন্য সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো বেশি তথ্যপ্রযুক্তিবান্ধব হয়ে উঠতে হবে। এই খাতে জনবল বাড়াতে হবে। তাদের আরো বেশি দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। এমন সব প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে, যাতে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রই ভয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে কোনো ধরনের উসকানি দেওয়ার সাহস না পায়।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক ও উপস্থাপক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।