সেই দুই কিশোরীর এসএসসি পরীক্ষা কাল, পুলিশ পাঠাল আদালতে
২০১২ সালে এক দম্পতির বিবাহবিচ্ছেদ হয়। এ দম্পতির তিন মেয়ে। বাবা একজন স্কুলশিক্ষক, মা গৃহিণী। বিচ্ছেদের পর দম্পতির তিন মেয়ে বসবাস শুরু করে রাজধানীতে থাকা দুই খালার সঙ্গে।
বিচ্ছেদের পর বাবা চলে যান যশোর। মা-খালাদের সঙ্গে জীবন গড়াতে থাকে তাদের। কিন্তু, ২০১৩ সালে তিন বোনের মা ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এরপর থেকে আর বাবার সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ ছিল না তিন মেয়ের।
তিন মেয়ের অভিযোগ, দুই খালা কখনোই তাদের বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেননি। এমনকি, কথা বলতেও দিতেন না। তিন বোনের একজন থাকত আদাবরের খালার বাসায়। অপর দুজন থাকত খিলগাঁও এলাকায় আরেক খালার বাসায়।
খিলগাঁওয়ের খালার বাসায় যে দুই কিশোরী থাকত, তারা এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। তাদের এসএসসির পরীক্ষাকেন্দ্র ধানমণ্ডি গার্লস হাইস্কুল। ফলে, পরীক্ষার জন্য তারা খিলগাঁও থেকে আদাবরের খালার বাড়িতে আসে। সেখানে থেকে তারা এরই মধ্যে একটি পরীক্ষাও দিয়েছে।
আগামীকাল রোববার তাদের আরেকটি পরীক্ষা রয়েছে এবং তারা পরীক্ষা দেবে বলে আশা প্রকাশ করছে।
ওই তিন বোন সব সময় আলাদা স্থানে থাকায় তাদের মধ্যে যোগাযোগও কম হতো। কেউ মুঠোফোন চালায় না। কিন্তু, পরীক্ষার সুবাদে তারা তিনজন একত্রিত হয়। অন্যদিকে এর আগে তারা জানতে পারে, তাদের বাবা অনেক অসুস্থ। এর আগেও কয়েকবার স্ট্রোক করেছেন। কিন্তু, প্রায় নয় বছর তারা বাবার দেখা পায়নি। বাবা শয্যাশায়ী, প্যারালাইজড। বিছানায় পড়ে থাকেন সব সময়।
এদিকে খালাদের ওপর তিন বোনের ক্ষোভ রয়েছে। খালাদের কাছে তারা অবহেলার শিকার বলে তাদের অভিযোগ। এসব কারণে গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর আদাবরের খালার বাসা থেকে তিন বোন কাউকে কিছু না বলে বের হয়ে যায় বাবাকে দেখতে। সেখানেই তারা থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। তারপর থেকে তারা নিখোঁজ ছিল।
ওই দিনই আদাবরের খালা সাজেদা নওরীন আদাবর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। সাজেদা নওরীন ধারণা করেন, তাঁর তিন ভাগ্নি টিকটকে আসক্ত থাকায় কারও প্ররোচণায় বাসা হতে বের হয়ে যেতে পারে। ফলে, এ ঘটনা নিয়ে চারিদিকে তোলপাড় শুরু হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের খুঁজতে থাকেন।
সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের পুলিশ জানতে পারে, তিন বোন যশোরের হামিদপুর চলে যায় তাদের অসুস্থ বাবাকে দেখতে। তারপর তেজগাঁও বিভাগের অনুরোধে যশোরের কোতোয়ালি থানা পুলিশ তিন বোনকে থানা হেফাজতে নেয়। আজ শনিবার সকালে তাদের ঢাকায় আনে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের পুলিশ।
শনিবার দুপুরে রাজধানীর শ্যামলীতে অবস্থিত তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনারের (ডিসি) কার্যালয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে ডিসি বিপ্লব কুমার সরকার ওপরের পুরো ঘটনা গণমাধ্যমকর্মীদের জানান।
পরে বিপ্লব কুমার সরকারের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এখন তিন বোনকে কার জিম্মায় দেওয়া হবে বা তারা কার কাছে যেতে চায়; এমন প্রশ্নে বলেন, তারা যেটা চায় সেটা এক ধরনের প্রশ্ন। আর আমরা কী করব, সেটা আরেক ধরনের প্রশ্ন। যেহেতু এটি একটি আলোচিত বিষয়, একটি জিডিও হয়েছে। সেহেতু আমরা তাদের আজ শনিবারই আদালতে হাজির করব। আদালত যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সে অনুযায়ী পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালিত হবে।’
‘আর তারা কী চায়, তা আদালতের কাছে বলব। আদালতও তাদের বক্তব্য জানার চেষ্টা করবেন হয়তো। তবে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিন বোন আমাদের বলেছে, তারা তাদের বাবার কাছে যেতে চায়’, যোগ করেন বিপ্লব কুমার সরকার।
ডিসি বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, ‘পুলিশ হেফাজতে আসার পর এসএসসি পরীক্ষার্থী দুই বোন বলেছে, তারা আগামীকাল দ্বিতীয় পরীক্ষা দিতে চায়। এখন আদালতের পরবর্তী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সবকিছু নির্ধারিত হবে। বাবার কাছে যাওয়ার সময়ও পরীক্ষা সংক্রান্ত সব কিছু তারা নিয়েছিল। হয়তো অন্য আত্মীয়ের বাসায় থেকে তারা পরীক্ষা দিত আগামীকাল।’
সাজেদা নওরীন জিডিতে অভিযোগ করেছিল টিকটক করার। কিন্তু, এ বিষয়ে পুলিশ কোনো সত্যতা পায়নি। বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, ‘টিকটক করার অভিযোগের কোনো সত্যতা আমরা পাইনি। শুধু তাই নয়, তারা তিন বোন কোনো মুঠোফোনই চালায় না। এবং এখন পর্যন্ত তাদের সঙ্গে কথা বলে আমরা যেটা জেনেছি, তাদের তিন বোনেরই কিছু ক্ষোভ আছে খালাদের নিয়ে। হয়তো তাদের প্রত্যাশা ছিল, খালাদের কাছ থেকে আরও ভালো ব্যবহার পাবে। কিন্তু, পায়নি। যদিও এসব ব্যাপারে আরো বিস্তারিত কথা বলে পরে জানতে হবে।’
ওই তিন কিশোরীকে আদালতে পাঠানোর বিষয়ে জানতে চাইলে আদাবর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ((ওসি) কাজী শাহিদুজ্জামান এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা পৌনে ৩টার দিকে তাদের আদালতে পাঠিয়ে দিয়েছি। তারা কি চায়, না চায় তা আদালতকে লিখিতভাবে জানিয়েছি। তাদের দুই বোনের কাল এসএসসি পরীক্ষা, সেটাও জানানো হয়েছে। এখন আদালত বাকি সিদ্ধান্ত নেবেন।’
কাজী শাহিদুজ্জামান আরও বলেন, ‘যশোর থেকে তিন বোনের কাকা ও দাদি ঢাকায় এসেছেন। আদালত যদি তাদের বাবার কাছে থাকার অনুমতি দেন, তাহলে তারা চাচা ও দাদির কাছে ঢাকায় থেকে পরবর্তী পরীক্ষাগুলো দেবে। আর খালাদের কাছে থাকার নির্দেশনা দিলে সেখানে থেকে পরীক্ষা দেবে।’