আসুন মানবিক মানুষ হই
ভারী বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢলে পুরো সিলেট অঞ্চল ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে। লাখ লাখ মানুষ এখন পানিবন্দি। পুরো সিলেট অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি নাজুক হলেও সুনামগঞ্জের অবস্থা খুবই উদ্বেগজনক। লাখ লাখ মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন, ঠাঁই নেওয়ার জন্য শুকনো জায়গাও খুঁজে পাচ্ছেন না। অনেক মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বজ্রপাতের কারণে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা নেমে এসেছে সেখানে। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক পানিতে তলিয়ে গিয়ে সারা দেশের সঙ্গে সুনামগঞ্জের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সেখানে পাওয়া যাচ্ছে না মুঠোফোনের নেটওয়ার্কও। জেলার প্রতিটি উপজেলাই কমবেশি প্লাবিত হয়েছে। অধিকাংশ ঘরেই হাঁটু থেকে গলাপানি। জেলা সদরের সঙ্গে পাঁচটি উপজেলার সরাসরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এ অবস্থায় পানিতে আটকেপড়া মানুষকে উদ্ধারে তিনটি উপজেলায় সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে। সিলেট শহরের বেশির ভাগ এলাকা ডুবে গেছে। বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। রানওয়েতে পানি ওঠায় সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান ওঠানামা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এক মাসের মধ্যে সিলেট অঞ্চল দ্বিতীয় বার বন্যাকবলিত হলো। ফলে আগের বন্যার ধকল না কাটাতেই নতুন করে দুর্যোগের মধ্যে পড়তে হয়েছে সেখানকার মানুষকে।
গত শুক্রবার সকাল থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। গত কয়েক দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে, আবার কমেও যায়। এর আগেও এমন হয়েছে, তবে বেশি সময় দীর্ঘস্থায়ী হয় না এ বৃষ্টি। তাই সিলেট শহরে তেমন একটা জলাবদ্ধতা তৈরি হয় না। কিন্তু সেদিন বৃষ্টি আর থামছিলই না। গত সপ্তাহে আমার অফিসের রমজান ভাই বলছিলেন, স্যার এই বছর খুব বড় বন্যা হবে বুঝি। সেই সময় আমি তার কথায় তেমন একটা পাত্তা দিইনি। ঘড়ির কাঁটায় সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু বৃষ্টি থামছিলই না। আমার চোখের সামনে প্রধান সড়কে প্রায় কোমরপানি। এর মাঝে বিপত্তি ঘটল, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। শুধু খারাপ খবর আসছিল সব দিক থেকে। সিলেটের আশপাশের নিম্নাঞ্চল আগে থেকেই জলাবদ্ধ ছিল, কিন্তু এখন সেই জায়গায় বুকসমান পানি। এর মাঝে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষের বন্যার পানি থেকে উদ্ধারের জন্য আকুতি চোখে পড়ছিল, কিন্তু কিছুই করার ছিল না। হঠাৎ বন্যায় আটকেপড়া মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য সাহায্য পাচ্ছে না। সিলেটের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার আকুতি ভেসে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। তিনি মানুষকে উদ্ধারের জন্য, পানিবন্দি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য নৌকা চান; পাচ্ছেন না। তিনি লিখেছেন, ‘কোথাও ট্রলারমালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে উজান এলাকা থেকে একটা ট্রলার-নৌকা কেউ ম্যানেজ করতে পারলে অতিসত্বর যোগাযোগ করুন।’ কতটা নিরুপায় পরিস্থিতিতে পড়লে এ রকম খোলা বার্তা একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দিতে পারেন। এদিকে বিদ্যুৎ, পানি, খাদ্যসামগ্রীর সঙ্কটকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী করে তোলেন। অনেক মানুষকে দশ টাকা দামের মোমবাতি ষাট টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছে।
অনেকেই বলছেন চেরাপুঞ্জির রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি বর্তমান পরিস্থিতির একমাত্র কারণ। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদ-নদী ও হাওরে এমন সব উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে যেগুলো পরিবেশসম্মত নয়। পানির স্বাভাবিক প্রবাহ এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সিলেট-সুনামগঞ্জ দুই শহরেই সুরমা নদীকে করে তোলা হয়েছে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়। সিলেটের নগরীর কালীঘাট থেকে টুকের বাজার, কালীঘাট থেকে দক্ষিণ সুরমা উপজেলার কুচাই এলাকা পর্যন্ত সর্বত্রই আবর্জনার ভাগাড়। একইভাবে সুনামগঞ্জ শহর এলাকায় সুরমা নদীর তীর এখন ময়লার ভাগাড়, আবর্জনার স্তূপ। সুনামগঞ্জ পৌর শহরের সাহেববাড়ি সেলুঘাট, উত্তর আরপিননগর, পশ্চিমবাজার, মধ্যবাজার, চাঁদনীঘাট, সুরমা হকার্স মার্কেট, জগন্নাথবাড়ি, প্রধান মাছ বাজার এলাকা, জেলরোড ফেরিঘাট এলাকা, লঞ্চঘাট এলাকা, উকিলপাড়া এলাকা, ষোলঘর এলাকায় নদীতীরে স্থানীয় লোকজন নিয়মিত হোটেল-রেস্তোরাঁর পচা ও উচ্ছিষ্ট খাবারসহ নানা রকমের বর্জ্য ফেলছেন। ফলে নদী হারিয়ে ফেলছে তার বহনক্ষমতা, নাব্যতা।
বন্যায় পানিবন্দি মানুষের অস্থায়ী দুর্ভোগ পোহাতে হয় দুই সময়। যখন বন্যায় পানিবন্দি থাকতে হয়, তখন এক ধরনের দুর্ভোগ। পানিবন্দি অবস্থায় অনেকের ঘরের ভিতর পানি ঢুকে পড়েছিল। হাঁটুপানি, কোমরপানি, গলাসমান পানি। কোনও কোনও জায়গায় ঘরবাড়ি ডুবে যায় পুরোপুরি। মানুষ অস্থায়ী মাচা বানিয়ে কিংবা বাড়ির ছাদে কোনও রকমে দুঃসহ সময় কাটিয়েছেন। ওদিকে তখন আবার বৃষ্টিও হয় কয়েক দিন। দুর্ভোগের ওপর আরও দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন বন্যার্তরা। তার ওপর ছিল ছিঁচকে চোর-ছিনতাইকারীর উপদ্রব। বন্যার পানি নামার পর শুরু হয় দুর্ভোগের দ্বিতীয় পর্যায়। বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট। সঙ্গে আছে খাবার সংকট, ঘরবাড়ি মেরামত সংকট, সেনিটেশন সংকট। যে কারণে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরেও মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয় মারাত্মকভাবে। ঘরে থাকা খাবারের মজুদ অনেক আগেই অনেকের ফুরিয়ে গিয়েছে। এ সময় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা করা এবং তা সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা করা জরুরি। তার চেয়েও জরুরি বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ করা।
তবে আসার কথা হলো এই যে বন্যাদুর্গতদের সাহায্যের জন্য অনেকেই এগিয়ে আসছে, কেউ আসছেন প্রতিষ্ঠান থেকে, কেউ বা ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে। পরিচয় দিচ্ছেন মানবিক মানুষ হিসেবে। আপনিও চাইলে এগিয়ে আসতে পারেন। বাড়িয়ে দিতে পারেন সাহায্যের হাত।
লেখক : ব্যাংকার, সিলেট