করোনা, কোরবানি ও স্বাস্থ্যবিধি
করোনাভাইরাসের বিপদের মধ্যেই এলো বন্যা, এর আগে এসেছিল ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। আর এসেছে কোরবানি। লকডাউন নেই, সবাই ঘরের বাইরে। হাটবাজার, দোকানপাট, বাজার সবই খোলা। গণপরিবহন চলছে, মানুষও ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কি করে চড়ছে সেগুলোয়। রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের যেকোনো জনপদ থেকে দেখলে মনে হবে না আমরা করোনার বিপদে আছি বা করোনা এখানে কখনো ছিল, যদিও প্রতিদিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দুপুর আড়াইটায় সরাসরি জানিয়ে দিচ্ছে করোনায় মৃত্যু, পরীক্ষা আর শনাক্তের হিসাব।
করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে যেসব স্বাস্থ্যসুরক্ষাবিধি আছে, সেগুলো মেনে চলা এক মহালড়াই বলেই মনে হচ্ছে আমাদের জন্য। বলা হয়েছিল কোরবানির হাট হবে, তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হবে। কিন্তু কী সেই স্বাস্থ্যবিধি সেটা বোঝা যাচ্ছে না। ক্রেতাদের ভেতর মাস্ক পরার লক্ষণ থাকলেও মুখাবরণ নেই গরু-ছাগল বিক্রেতাদের। গণমাধ্যম হরহামেশা রিপোর্ট করছে এ নিয়ে।
এক সপ্তাহেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে মাস্ক পরা বাধ্যতামুলক করে আদেশ জারি করেছে সরকার। বলা হয়েছে, সব ধরনের কর্মস্থলে, বাজার-বিপণি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়, গণপরিবহন, সামাজিক অনুষ্ঠান এবং রাস্তায় পথচারীদেরও এখন থেকে এ নিয়ম মেনে চলতে হবে। বাধ্যতামূলক হলেও মানছে কত জন?
টেলিভিশন সংবাদিকরা জিজ্ঞেস করছেন, মাস্ক নেই কেন? মানুষ হেসে-খেলে নানা রকম হাস্যকর উত্তর দিচ্ছেন। গরুর হাট থেকে আধুনিক শপিং মল, পাড়ার দোকান থেকে রাস্তাঘাট সবখানে এই চিত্র। আমাদের একটি বড় শ্লাঘার অনুভূতি নিয়ম না-মানা। সেই মানসিকতাই অনেকের মাঝে দেখছি এই করোনাকালে। আমাদের মনোজগতে এই বোধ আক্রান্ত করেছে, আমার মুখোশ পরার দরকার নেই। এই বাহাদুরি করছেন তাঁরাই, যাঁরা নিজেদের করোনাজয়ী ভাবছেন।
রাস্তাঘাটে দেখছি কেউ কেউ পরছেন, তবে সেটি ঝুলে আছে থুতনিতে বা কানে বা গলায়, যেন এক নিউ নরমালের মতো এক নয়া অলংকার। আমাদের সামগ্রিক জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা হয়তো এমন যে গুরুতর একটি জনস্বসাস্থ্য সমস্যায় মাস্কের অব্যবহার বা অপব্যবহার করে কীভাবে নিজের ও অন্যের ক্ষতি করছেন, তা বোঝাতে পারিনি মানুষকে। যিনি আক্রান্ত হননি, তিনিও মাস্ক না পরলে অথবা আক্রান্ত হয়েও উপসর্গহীন থাকেন, তাহলে অন্যের ক্ষতি করতে পারেন সেই বোধ, সেই সচেতনতা ব্যাপক জনমনে সৃষ্টি করা যায়নি।
একদিকে সরকার মানুষকে বলছে, আপনারা ঘরে থাকুন, আবার সরকারই পরিবহনসহ সব ব্যবস্থা রেখেছে। সরকার কেন ঘরে থাকতে বলছে, কারণ করোনাভাইরাসের জন্য যেকোনো গণজমায়েতই মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে। আবার কেন সব খোলা রেখেছে? কারণ সরকার কাউকে অখুশি রাখতে চায় না। সবাই সবকিছু করুক। এর মধ্যেই দক্ষিণাঞ্চলের পথে চলা লঞ্চগুলোতে ভিড় করে মানুষকে ঢাকা ছাড়তে দেখছি আমরা। বাসের দৃশ্যটা হয়তো বুঝব শেষ সময়ে।
যেখানে করোনা পরিস্থিতির কারণে হজ ও মসজিদে নামাজের ক্ষেত্রেও নতুন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে সৌদি আরবকে, সেখানে এ পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে কোরবানি নিয়ে আগে থেকে পরিকল্পিত প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। করোনা সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটির সুপারিশ উপেক্ষা করে ঢাকাসহ করোনার হটস্পটগুলোতে গরুর হাট বসানো হয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বলেছিল, তথাকথিত স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে বরাবরের মতোই কোরবানির পশুর হাট বসানো হবে। তবে এখন যখন দেখা যাচ্ছে সেই বিধি মানা হচ্ছে না, তখন এ মন্ত্রণালয় নীরব থাকার কৌশল গ্রহণ করেছে।
আমাদের দেশব্যাপী লকডাউন একদিনের জন্যও হয়নি, যা সব দেশেই হয়েছে। সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির সময়ে আমরা দেখেছি লোকে কীভাবে ঘুরে বেড়িয়েছে, পাড়ায়-পাড়ায় আড্ডা দিয়েছে, বাজার করেছে। ছুটির উদ্দেশ্যই ছিল এই ভাইরাসের গতি রোধ করা। একজন মানুষ অন্যের সংস্পর্শে যাতে না আসেন বা কম আসেন। ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি ঠেকানো। কিন্তু আমরা হঠাৎ করে সব খুলে দিয়ে করোনা পরীক্ষাও কমিয়ে দিয়েছি। পরীক্ষা কমিয়েছি, কিন্তু আক্রান্তের হার কমাতে পারিনি।
বলা হচ্ছে, এখন ঢাকার বাইরে সংক্রমণের হার বেশি। তার মধ্যে ঈদ করার জন্য একদিকে বন্যার আঘাত, অন্যদিকে দলবেঁধে লোকজন করোনা হটস্পট এলাকা থেকে ছুটছে দূর-দূরান্তে। জনসমাগম ঠেকানোর সামান্য প্রচেষ্টাও কোথাও লক্ষ্যণীয় নয়।
ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন মাংস প্রক্রিয়াজাত করার কারখানা এবং কসাইখানার কর্মীদের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঘটনা বেশি ঘটেছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে করোনাভাইরাসসের সংক্রমণ হয়েছে। তাহলে আমাদেরও ভাবনার প্রয়োজন। বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোয় কোরবানির জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মৌসুমি কসাই এসে ভিড় করেন। এবারও হয়তো হবে। এসব কসাইয়ের কেউ করোনা আক্রান্ত কি না তা সহজে নির্ণয় করার কোনো উপায়ও নেই। তাই করোনাকালে কোরবানি যিনি দিচ্ছেন তিনি ও তাঁর সহযোগীরা কি ঝুঁকি নিচ্ছেন, সেটা তাঁরাই ভাববেন।
স্বাস্থ্যবিধি কতটা সূক্ষ্মরূপে মানা হবে, সে নিয়ে সংশয় আছে। মাস্কেই সম্পূর্ণ মুক্তি মিলবে কি না সেটাও জানা নেই। তবে মাস্ক না পরে বাহাদুর সাজার কিছু নেই। অপরিচিত কসাইদের সঙ্গে কাজ করা, তদারকি করার সময় নাক ও মুখ ঢাকতেই হবে। কারণ মাস্ক না পরলে নিজের পরিজনদেরও ক্ষতি করতে পারেন যে কেউ তাঁর অজান্তেই।
লেখক : সাংবাদিক