শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের নেপথ্যে
শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কিছু প্রধান কারণ রয়েছে। একটি দেশের অর্থনীতিতে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কিছু সেক্টর থাকে। আর এই বাহ্যিক সেক্টরের ফরেন কারেন্সি নিয়ে শ্রীলঙ্কা আজ এই বড় ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি হচ্ছে সার্ভিস অরিয়েন্টেড অর্থাৎ সেবাখাতমূলক অর্থনীতি। পর্যটনখাত তাদের আয়ের একটি বড় উৎস। করোনা শুরুর পর থেকে গত দুই বছর ধরে পর্যটকেরা দেশটিতে ধারাবাহিকভাবে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। তাই শ্রীলঙ্কার এই পর্যটনখাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তাদের আয় কমে গিয়েছে। ফলে দেশটিতে ডলার আসেনি। আর ডলার না আসাতে আমদানি বন্ধ হয়ে পড়েছে এবং দেখা দিয়েছে আমদানি সংকট।
দ্বিতীয়ত, সারা পৃথিবীতে পেট্রোলিয়ামের দাম কয়েক গুণ হারে বেড়ে গেছে। শুধু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ নয়। এর সঙ্গে কিছু গ্লোবাল সংকটও রয়েছে। সব মিলিয়ে পেট্রোলিয়ামের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। সেটা অবশ্য ইউক্রেন যুদ্ধের আগেই বেড়েছিল। এখন তো আরও বেশি বেড়েছে। জ্বালানি সংকট দূর করতে হলে তো অন্য দেশ থেকে জ্বালানি আমদানি করতে হয়। আগে যেটার দাম ছিল ব্যারেল প্রতি ৪০ ডলার, সেটা এখন হয়েছে ১৪০ ডলার। ব্যারেল প্রতি যদি ১০০ ডলার বেড়ে যায়, তখন একটি দেশের জন্য পেট্রোলিয়ামের মিলিয়ন মিলিয়ন ব্যারেল আমদানি করতে বিশাল অঙ্কের ফরেন কারেন্সি লাগে। একদিকে দীর্ঘ দিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের সংকট তো ছিলই। অন্যদিকে পেট্রোলিয়াম আমদানি করতে ব্যাপক বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়ে যাচ্ছে।
এ ছাড়া অবকাঠামোগত কিছু বড় বড় প্রজেক্টের জন্য চীন থেকে ঋণ নিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। কোনো প্রজেক্ট বিদেশি ঋণনির্ভর হলে সেই ঋণ তো বার্ষিক সুদের হারে ডলারে পরিশোধ করতে হয়। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা যদি না আসে, সেগুলো পরিশোধ করা যায় না। এখান থেকেই মূলত তাদের বৈদেশিক মুদ্রার সংকট দেখা দিয়েছে। যখন কোনো পণ্য আমদানি করা যায় না, তখন দেশে যেটুকু উৎপাদন হয় সেগুলোরও দাম বেড়ে যায়।
প্রধানত পেট্রোলিয়ামের সঙ্গে সবকিছুর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এটার দাম বেড়ে গেলে কৃষি, ট্রান্সপোর্ট ও উৎপাদনের খরচও বেড়ে যায়। এ জন্য পেট্রোলিয়াম হচ্ছে একটা মৌলিক পণ্য, যেটা সব উৎপাদনের সঙ্গেই জড়িত। এ জন্য দেশটিতে বিদ্যুতের উৎপাদন প্রায় বন্ধের পথে। ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছাড়াই দিন পার করতে হচ্ছে তাদের। পেট্রোলিয়ামের দাম যদি বৈশ্বিকভাবে বেড়ে যায় তাহলে আমদানিকারক দেশগুলো প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশ শতকের আশির দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশেও এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। তবে শ্রীলঙ্কার মতো এত ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়েনি। কিন্তু কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। বাংলাদেশ তো শ্রীলঙ্কার মতো পর্যটনখাত থেকে তেমন আয় করে না। আমাদের দেশের নিজস্ব গ্যাস রয়েছে। ফলে যে পরিমাণে পেট্রোলিয়াম আমদানি করার প্রয়োজন হয়, সেটা বাংলাদেশের করতে হয় না। স্বাভাবিকভাবে অনেকগুলো সমীকরণের কারণে বাংলাদেশ এ রকম ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়েনি। কিন্তু শ্রীলঙ্কা খুব বিপদে পড়ে গেছে।
এদিকে ভারত শ্রীলঙ্কাকে দেড়শো মিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার কথা বলেছে। আমার যদি এক গামলা পানির প্রয়োজন হয়, আর সেখানে কেউ আমাকে এক চা চামচ পানি দিল, এতে কিন্তু আমার পানির সংকট থেকেই যাচ্ছে। বিষয়টা ঠিক এমনই। একটা অর্থনীতির জন্য এ রকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঋণ খুব একটা অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে না। তারা এখন বিশ্ব ব্যাংক কিংবা ধনী রাষ্ট্রগুলোর কাছে কম সুদে ঋণ চাইতে পারে। ভারত তো নিজেই ঋণ করে। ভারত বা বাংলাদেশ হয়তো অল্প কিছু ধার দিতে পারে। একই সঙ্গে তাদের যেন আবার এক্সপোর্ট ডলার আসে, সেভাবে এগোতে হবে। আর যাদের ঋণ এখনও পরিশোধ করছে, তাদের ঋণের টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিতে হবে। প্রয়োজনে দশ বছর ঋণ পরিশোধ করবে না। এ ধরনের ঘটনা পৃথিবীতে অনেক রয়েছে। যেহেতু ঋণ নিয়ে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে, সেহেতু এখন শোধ করবে না। পরে দেবে। এ রকমভাবে শ্রীলঙ্কা তাদের অর্থনীতিকে পুনরায় ফিরে আসতে হবে। সেখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এ ছাড়া তাদের আর অন্য কোনো রাস্তা নেই।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়