শ্রীলঙ্কার সংকটের জন্য গোষ্ঠীতন্ত্রই দায়ী
শ্রীলঙ্কার ঘটনাবলি প্রতি মুহূর্তেই পরিবর্তন হচ্ছে। আজকে যা ঘটছে তার নিরিখে আগামীকাল কী ঘটবে তা বলা যাচ্ছে না। বর্তমান সরকার এই পরিবর্তনের মধ্যেই টিকে থাকার চেষ্টা করছে। সরকার আশাবাদী, কেননা এই সরকারের নেতৃত্বেই দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধের অবসান হয়েছিল এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী তামিল টাইগারদের উচ্ছেদ হয়েছিল। সুতরাং চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সক্ষমতা এই নেতৃত্বের রয়েছে। তবে বর্তমান সংকটের বাস্তবতাও ভিন্ন। একদিকে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, অন্যদিকে বিশ্ব অর্থনীতির অনিশ্চিত গন্তব্য—উভয়ে মিলে শ্রীলঙ্কার বর্তমান নেতৃত্বের সামনে উত্তরণের পথকে করেছে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। এর চেয়েও বড় ব্যাপার এই যে শ্রীলঙ্কার সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত যে গোষ্ঠীতন্ত্র, তারাই আজকের এ অবস্থার জন্য দায়ী বলে জনগণ মনে করছে।
আসলে শ্রীলঙ্কার জনগণ পরিবর্তন চাচ্ছে। জনগণ মনে করছে, এই সরকার এবং এই গোষ্ঠীতন্ত্রের অধীনে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে মুক্তির সম্ভাবনা নেই। তাঁরা আংশিক নয়, পুরো রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরিবর্তন চায় এবং রাজপথে থেকে সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছে।
এদিকে বর্তমান রাষ্ট্রপতি পদত্যাগে আগ্রহী নন; বরং তাঁর কর্মসূচি ও গোষ্ঠীতন্ত্রকে সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে টিকিয়ে রেখেই বর্তমান সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। এর অংশ হিসেবে তিনি তাঁর সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ প্রভাবশালী মন্ত্রীদের সরিয়ে দিয়ে নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছেন, জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছেন; এমনটি ‘নো পাকসা’ টাইপ সরকার গঠনেও রাজি আছেন। অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য তাঁর সরকারের গৃহীত নীতি-কর্মসূচিগুলোও পরিবর্তন ও সংস্কার করেছেন। যেমন ২০১৯ সালের পর তারা মূল্য সংযোজন করসহ যেসব কর ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়ে রাজস্ব ঘাটতির মুখোমুখি হয়েছিলেন, সেসব কর আবারও আরোপ করেছেন। কৃষিতে যে কেমিক্যাল ফার্টিলাইজার নিষিদ্ধ করে অর্গানিক ফার্টিলাইজার চালু করেছিলেন; যার জন্য কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হওয়ায় খাদ্যশস্য আমদানি ব্যয়ে রিজার্ভ খালি হয়ে পড়ে; সেখান থেকেও তারা ফিরে এসেছে। এ রকমভাবে অনেক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচি থেকে পাকসা সরকার ফিরে এসেছে। কিন্তু এসব করেও তারা শ্রীলঙ্কার জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেনি।
এখন দেখার বিষয় শ্রীলঙ্কার জনগণের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার শক্তি কতটুকু; অথবা সরকার কীভাবে সেনাবাহিনী দিয়ে আন্দোলনকারীদের মোকাবিলা করে সেটি। এটাই সত্য এবং সব দেশেই এটা ঘটে যে জনগণ একবার ফুঁসে উঠলে সেনাবাহিনী দিয়েও তাদের থামানো যায় না। তবে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি একটু ভিন্নতর। সে দেশে দীর্ঘদিন একটি গৃহযুদ্ধ ছিল। বর্তমান গোষ্ঠীতন্ত্রই সেই গৃহযুদ্ধে জয়লাভ করে জনগণ-মন-নন্দিত হয়ে ক্ষমতায় আসে। তাছাড়া বর্তমান আন্দোলনটি এখনও পর্যন্ত শহরকেন্দ্রিক, প্রকৃতপক্ষে তা রাজধানীকেন্দ্রিক। এটা এখনও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েনি এবং সেনাবাহিনীও ক্ষমতা গ্রহণে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে না। তাঁরা বর্তমান সরকারকেই এখনও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। বিরোধী দলের দাবি অনুযায়ী, নতুন সরকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে একটি নতুন নির্বাচন দেওয়ার জন্য যে আর্থিক সক্ষমতা তা-ও এই মুহূর্তে সরকারের নেই। জনগণের প্রাত্যহিক প্রয়োজন মেটানোই এখন জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্রীলঙ্কার সিভিল সোসাইটির ভূমিকাও শক্ত নয়; তারা কী পন্থা অবলম্বন করবে তা বলাও মুশকিল। তবে এটি নিশ্চিত যে, এই সংকটের জন্য বর্তমান গোষ্ঠীতন্ত্রই দায়ী। তাদের অপরিণামদর্শী ও উচ্চাভিলাষী আর্থিক পরিকল্পনা ও ব্যাপক দুর্নীতির জন্যই বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আমেরিকার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে। ১৯৩০-এর দশকে আমেরিকার অর্থনৈতিক মন্দা, যেটি পুঁজিবাদী অর্থনীতির ইতিহাসে এক বড় কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট যে কৌশল নিয়েছিলেন তা হলো জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা। মন্দাকালীন রিপাবলিকান সরকারের প্রেসিডেন্ট হাবার্ট হুভার সব ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থাই গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সেগুলো কোনো কাজে আসেনি। কেননা জনগণ মনে করেছিলে যে, যত ধরনের ব্যবস্থাই নেওয়া হোক না কেন, এই সরকারের অধীনে আসলে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়। ফলে ওই সরকারের পতন ঘটল। নতুন প্রেসিডেন্ট, ফ্রাঙ্কলিন ডিলানো রুজভেল্ট (এফডিআর), তার পূর্বসূরির মতো প্রায় একই রকম কর্মসূচি প্রদান করেন একটু ভিন্ন কায়দায়, নতুন নাম দিয়ে। জনগণ এবার আস্থা ফিরে পায়, তারা রুজভেল্টকে সমর্থন দেয়, ফলে ধীরে ধীরে আমেরিকা মন্দা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়।
শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকার কিছু রিকভারি কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। জনগণের সমর্থন পেলে তারা এসব কর্মসূচির মাধ্যমেই বর্তমান সংকট উতরে যেতে পারে। কিন্তু জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে না পারলে তারা রিকভারি করতে পারবে না বলেই মনে হয়। কেননা যে জনগণের জন্য কর্মসূচি, তারা যদি সমর্থন না দেয়, কর্মসূচি পালন না করে, তাহলে কোনো ম্যাকানিজমই কাজ করবে না, যেমনটা মার্কিন প্রেসিডেন্ট হুভারের ভাগ্যে ঘটেছিল। মার্কিন ইতিহাসে অত্যন্ত চৌকস প্রেসিডেন্ট হওয়া সত্ত্বেও জনগণের আস্থা না পেয়ে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। সুতরাং শ্রীলঙ্কার বর্তমান নেতৃত্বের প্রধান কাজ হবে জনগণের আস্থা ফেরানো অথবা রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও শোচনীয় হওয়ার পূর্বেই ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়া। এমনও হতে পারে যে, বর্তমান সরকারের গৃহীত কর্মসূচিই নতুন নেতৃত্ব বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে; কেননা তারা জনগণের আস্থা ও আশার প্রতীক হয়ে আসবে। আবার, জনগণের আস্থা অর্জনে সক্ষম নেতৃত্বের প্রতিই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেবে।
মোটকথা, বর্তমান সরকারকে তার জনগণকে কনভিন্স করতে হবে নতুবা নতুন নেতৃত্বের পথ সুগম করতে হবে। এটা দেরি হলে শ্রীলঙ্কার জনগণের যেমন ক্ষতি হবে, তেমনই বর্তমান সরকারের পেছনে ক্রীয়াশীল গোষ্ঠীতন্ত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই সরকার যদি আন্দোলনরত রাজনৈতিক শক্তির সাথে সমঝোতার মাধ্যমে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়, তাহলে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরেও রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকতে পারে, কিন্তু তারা যদি এই রাজনৈতিক সহিংস পরিস্থিতিকে আরও টেনে নিয়ে যায় তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। এটি শ্রীলঙ্কার জন্যই ক্ষতিকর হবে। কেননা কোনো দেশেই সরকার ও বিরোধীদলের রাজনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে সহিষ্ণুতা ও ভারসাম্য না থাকলে কল্যাণ আসে না। এখানে গণতন্ত্র একটি বড় ব্যাপার। এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কার সংকট থেকে বেরিয়ে আসা কোনো সিঙ্গেল এনটিটির মাধ্যমে সম্ভব নয়।
সংকট উত্তরণের জন্য জনগণ, সিভিল সোসাইটি, সেনাবাহিনী এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে একযোগে কাজ করতে হবে। সব পক্ষকে মিলেই একটি জাতীয় সমঝোতায় আসতে হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথেও বোঝাপড়া করতে হবে; কেননা শেষোক্তদের সহায়তা ছাড়া শ্রীলঙ্কার একার পক্ষে উঠে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। এখানে ভারত ‘মেডিয়েটরের’ ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ, অতীত থেকেই ভারত প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে বড় ভূমিকা পালন করে এসেছে। তবে এখন পর্যন্ত ভারতের কোনো শক্তিশালী প্রকাশ্য ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না।
সার্বিক কথা হলো, শ্রীলঙ্কার যে সংকট তা অবশ্যই অর্থনৈতিক সংকট। তবে এটি সৃষ্টি করেছে রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো। এসব গোষ্ঠীর সাথে জনগণের কীভাবে সমঝোতা হয়, তার ওপর নির্ভর করছে সমস্যাটি কত দূর গড়াবে। বর্তমান সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক সমর্থনও খুব বেশি নেই। অনেক দেশ ও সংস্থা তাদের ঋণ দিতে আগ্রহী নয়; কেননা তারা পূর্বের ঋণ শোধ করতে না পারায় আস্থা হারিয়েছে। শ্রীলঙ্কার এ মুহূর্তে বৈদেশিক ইনভেস্টমেন্ট সাপোর্ট দরকার; সেটি ঋণ আকারেই হোক কিংবা যেকোনো আকারেই হোক। কারণ, তাদের রিজার্ভ শূন্যের ঘরে। তাই তাদের ঋণ দরকার, তবে তা সরল সুদে, কমার্শিয়াল ঋণ নয়।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কোনো বিদেশি শক্তি ঋণ দিতে কিংবা বিনিয়োগে আগ্রহী হবে না। কেননা কেউই তাদের অর্থ জলে ফেলতে চাইবে না। বর্তমান সরকারের আমলে যে বৈদেশিক ঋণ রিকভারি হওয়া সম্ভব নয়, তা বিদেশি শক্তিগুলো বুঝে গিয়েছে। ফলে এখন উপায় হলো শ্রীলঙ্কায় এমন এক সরকার প্রতিষ্ঠা করা, যার ওপর দেশি-বিদিশি সব পক্ষের আস্থা থাকবে। আর সেটা হলেই শ্রীলঙ্কা বৈদেশিক ঋণ পেতে সক্ষম হবে এবং রিকভারি প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে। আর এভাবেই শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে আনা সম্ভব। শ্রীলঙ্কার সুবিধা হলো দেশের প্রায় শতভাগ মানুষ সাক্ষর। এই বিপুল শিক্ষিত জনগোষ্ঠী উপযুক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব পেলে যেকোনো পরিস্থিতিই মোকাবিলা করতে সক্ষম। তবে এটাও ঠিক যে শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতি দেশটিকে দীর্ঘমেয়াদে ভোগাবে; কেননা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোনো সহজ পথ এখনও উঁকি দিচ্ছে না।
লেখক : বিভাগীয় সভাপতি ও সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়