শ্রদ্ধা
স্বপ্নবান বিপ্লবী কমরেড নির্মল সেন
নির্মল সেন। ত্যাগী, নির্লোভ একজন মনীষী। একজন রাজনীতিক। স্বাভাবিকভাবেও একজন মানুষ সৎ থাকেন, অসৎ হওয়ার সুযোগ পেয়ে সৎ থাকা এক পরীক্ষিত নিষ্ঠুর বাস্তবতা। নির্মল সেন সত্যরসে জারিত এক জীবনের নাম। মার্কসবাদী দর্শনের প্রতি একনিবষ্টি এই মনীষী শ্রেণিসংগ্রামকে জীবনদর্শন হিসেবে নিয়েছিলেন। তাঁর মতো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিক খুবই কম। সাদা পাজামা, কোড়া রঙের খদ্দরের পাঞ্জাবি পরতেন। পরিচ্ছন্ন ও অসম্ভব ব্যক্তিত্ববোধসম্পন্ন এ মানুষটি নির্লোভ ও সাহসী। সাংবাদিকতায় সততার প্রশ্নে যাঁদের দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়, তিনি তাঁদের অন্যতম। সুবিধা নেওয়া কী, তা তিনি জানতেন না। স্পষ্ট বক্তা ছিলেন তিনি। আলোতে যা বলতেন, অন্ধকারে তা-ই বলতেন।
তৎকালীন দুর্গম এলাকা কোটালীপাড়া থেকে এসে নির্মল সেন সারা দেশের মানুষের কাছে নির্মলদা—এক আস্থার প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন। স্বপ্নবান মানুষ ছিলেন। শ্রেণিসংগ্রাম ছাড়া সমাজ বিপ্লব সম্ভব নয়, এটা তিনি বুঝতেন। তাঁর জীবনে সে চর্চাও করেছেন আমৃত্যু। তাঁর বন্ধু-বান্ধব-শুভানুধ্যায়ী-অনুসারী সবখানে আছে, ছিল। যে জন্য যে কেউ তাঁর কাছে চাকরি বা কোনো কাজের জন্য এলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলে দিতেন, কাজ হতো। তার পরে কেউ যোগাযোগ রাখবে এমন প্রত্যাশা তাঁর কোনোকালে ছিল না। রাখত কেউ আমার জানা নেই। ১২ নয়াপল্টনের বাসা থেকে নিজের অফিস তোপখানা রোডে হেঁটেই যাওয়া-আসা করতেন। হাঁটার প্রশ্নে বলতেন, হাঁটলে শরীরের যেমন উপকার হয়, গণসংযোগও হয়। কত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, কত কথা হয়—যেটা অন্য কোনোভাবে সম্ভব নয়। নির্মল সেনের ব্যক্তিত্ববোধ, তাঁর পাণ্ডিত্য সব মিলিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে সাহস হতো না। তাঁকে দূর থেকে দেখেই শ্রদ্ধা করতাম। এটা কোটালীপাড়া কলেজজীবনের কথা। তিনি বাড়ি এলে এলাকার সব বাম রাজনীতিক দলের লোকজন ভিড় করত। জানতে চাইত রাজনীতির খবর। শত লোকের ভিড়ে একান্তভাবে একজন শিক্ষকের মতো বোঝাতেন তিনি। শ্রেণিগত অবস্থান থেকে কোন দলের ভূমিকা কী, সব বলতেন অকপটে। তাতে কে খুশি হতো, কে হতো না—সেদিকে তাকানোর মানুষ নির্মল সেন ছিলেন না।
আমি যখন তাঁর সাহচর্যে আসি, তখন আমি ঢাকায় থাকতে শুরু করেছি। দু-একদিন কথা হয়েছে। তিনি তাঁর অফিসে সময় পেলে যেতে বলতেন। জনকণ্ঠ পত্রিকায় তখন সম্পাদনা সহকারী নেওয়া বিজ্ঞাপন দিলে আমি আবেদন করেছিলাম। আমার ইন্টারভিউ কার্ড এলে ওটা নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। তিনি কার্ডটা নিজের কাছে রেখে বললেন, তোমার টাকার প্রয়োজন হলে আমি যেসব কাগজে লেখি, সে লেখাগুলো লিখো। চলার টাকাটা আমি দেব। আরো পড়াশোনা করতে হবে। বই পড়ো, অনেক বই। এর মধ্যে আজকের কাগজে আমার কাজ হয়ে গেল আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিনিধি সাংবাদিক নেতা কুদ্দুস আফ্রাদ ভাইয়ের এক চিঠিতে। প্রয়াত মারুফ চিনু ভাইয়ের কাছে লেখা ও চিঠিই ছিল চাকরি সূত্রপাত। নির্মল সেনের অফিসে আমার অফিস থেকে ফেরার পথে যেতাম প্রায়ই। মাঝেমধ্যে উদীচীর কাজে ব্যস্ত থাকলে তিনি ফোন দিতেন যেতে। অফিসে ছিল নির্মল সেন অন্তপ্রাণ অদুদ ভাই। তিনি খুব খুশি হতেন আমি গেলে।
নির্মল সেন থাকাকালীন অনাহূত কেউ তাঁর রুমে ঢুকলে অদুদ ভাই রেগে যেতেন। আমার ক্ষেত্র ছিল শুধু আলাদা। আমি গেলেই নির্মল সেন লিখতে বসতেন। তাঁর লেখা অধিকাংশ সময় আমি লিখতাম। এ ধরনের লেখাকে ডিক্টেশন নিয়ে লেখা বলে। নির্মল সেনের লেখার ধরন ছিল সবার চেয়ে আলাদা। লেখার আগে বলতেন, ভালো কাগজ নিয়েছিস? ভালো কাগজ মানে অফসেট পেপার। ভালো কলম মানে লিখতে ডিস্টার্ব করবে না, ভালো কালি সরবরাহ করবে এমন কলম। ভালো কাগজ-কলম ছাড়া তিনি লিখতে পছন্দ করতেন না। লেখার আগে দরজা বন্ধ করে দিতেন। হেমন্তর গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত ধরতেন গলায়। একসময় বলতে শুরু করতেন, আমি লিখতাম। লেখার কোথায় প্যারা, কোথায় দাড়ি, কমা সব বলে দিতেন। শেষ হলে বলতেন, এবার অনুলিখনে নিজের নামটা লিখে দে। আমি লিখতে না চাইলে তিনি বলতেন, এটা না লিখলে লেখকের অসততা মনে হয়। লেখার পর খাওয়ার পর্ব। কত সহজ নির্মল সেন তখন। লেখার আগের পাহাড়টাকে, লেখার পরে নদী মনে হতো।
মুড না এলে তিনি কখনোই লিখতেন না। আহমদ ছফাও এ কাজটা করতেন। নির্মল সেন ট্রটস্কিপন্থী ছিলেন। অন্যান্য কমিউনিস্ট দল সোভিয়েত বিপ্লবকে নিয়ে লেনিন-পরবর্তী স্টালিনের শাসনকে সঠিক মনে করলেও নির্মল সেন স্টালিনের শাসনকে স্বৈরব্যবস্থা বলেই মনে করতেন। মেক্সিকোতে পলাতক থাকলেও সেখানে স্টালিনের লোকজন তাঁকে হত্যা করেছিল। নির্মল সেন পার্টির তাত্ত্বিক জায়গা থেকে মনে করতেন, লেনিনের পর সবচেয়ে মেধাবী কমিউনিস্ট নেতা ট্রটস্কির সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হওয়া উচিত ছিল। এ নিয়ে বিতর্ক করতে করতে তাঁর জ্ঞানের পরিমাপ করা যেত।
শিল্পসাহিত্য বিষয়েও তিনি খুবই অনুরাগী ছিলেন। এভাবে দিন কাটল ভালোই। কথার মধ্য দিয়ে জেনেছিলাম, তাঁর লেখালেখি শুরু হয় অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন ‘কমরেড' পত্রিকার মধ্য দিয়ে। ইত্তেফাকে সাংবাদিকতা করেছেন, ১৯৬৪ সালের ৬ অক্টোবর দৈনিক পাকিস্তান, পরে দৈনিক বাংলা পত্রিকায় একটানা ৩৩ বছর সাংবাদিকতা করেন। প্রেস ট্রাস্টের এই পত্রিকা ১৯৯৭ সালে বন্ধ হওয়ার দিন পর্যন্ত নির্মল সেন এই পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন।
১৯৭২-৭৩ সালে নির্মল সেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ও ১৯৭২-৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্য। আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য বারবার জেলে গেছেন। এর মধ্যেও তাঁর লেখাপড়া বন্ধ থাকেনি। ১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ পাস করেন। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে গঠিত বামপন্থীদের পাঁচ দলের নেতৃত্ব দেন কমরেড নির্মল সেন। বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠনেও নির্মল সেন নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আন্দোলন-সংগ্রাম, জেল, অনশনের মধ্যেও তিনি লিখেছেন অবিরাম। তাঁর সব লেখা আজও সংগৃহীত হয়নি। এর মধ্যে তাঁর যেসব বই প্রকাশ হয়েছে, তা দেশের রাজনৈতিক দলিল। তাঁর ‘মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্র', ‘বার্লিন থেকে মস্কো', ‘পূর্ববঙ্গ-পূর্ব পাকিস্তান-বাংলাদেশ', ‘মা জন্মভূমি', ‘লেনিন থেকে গর্ভাচেভ', ‘আমার জবানবন্দী', ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই' ও ‘আমার জীবনে ৭১-এর যুদ্ধ' খুবই গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।
২০১৩ সালের ৮ জানুয়ারি দেহ ত্যাগ করেন। ১২ নয়াপল্টন বা তোপখানা রোডে শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দলের কার্যালয়ের পাশ দিয়ে যাই, এক বিষাদের সুর বেজে ওঠে। শহরের অভিভাবক নেই। তাঁর চিহ্ন সবখানে। অদুদ ভাই চলে গেছেন তাঁরও আগে। বিনয়ী ছাত্রনেতা বজলুর রশীদ সেন্টু প্রবাসে। আর কমরেড নির্মল সেন নিরন্তরের পথিক। তিনি বেঁচে আছেন, থাকবেন। এমন সত্য নির্মোহ, মনীষীদের মৃত্যু হয় না।
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক।