স্মরণ
মধুর ১৯৩তম জন্মবার্ষিকী আজ
মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতম কবি ও বিখ্যাত নাট্যকর। সে কারণে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর নাম অনন্য সাধারণ হয়ে আছে। বাংলা কাব্যে মধুসূদনই প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন করেন।
যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে মধুসূদন ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জমিদার রাজনারায়ণ দত্ত ও মা জাহ্নবি দেবী। সাগরদাঁড়ির শেখপুরার পাঠশালাতেই মধুসূদনের বাল্যশিক্ষা শুরু হয়। এরপর তিনি খিদিরপুর স্কুলেও পড়াশোনা করেন। তিনি ১৮৩৩ সালে হিন্দু কলেজের জুনিয়র স্কুলে ভর্তি হন। মেধাবী ও কৃতী ছাত্র হিসেবে তাঁর যথেষ্ট সুনাম ছিল। মধুসূদন যখন কলেজের ছাত্র, সে সময় তিনি নারীশিক্ষা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখে স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। মধুসূদন বাল্যকাল থেকেই ইংরেজি ভাষা সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হন, যার কারণে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য সাধনকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। আর সেই থেকে ইংরেজি ভাষায় কাব্যচর্চা করতে থাকেন, যা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পেতে থাকে। এ সময় তাঁর মনে বিলেতে যাওয়ারও প্রবল আকাঙ্ক্ষা জন্ম নেয়। ১৮৪৩ সালে তিনি খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। এর পর থেকে তাঁর নামের পাশে ‘মাইকেল’ শব্দ যুক্ত হয়ে যায়।
আপন ধর্ম ত্যাগ করার কারণে তাঁকে হিন্দু কলেজ ত্যাগ করতে হয়। তিনি শিবপুরে বিশপস কলেজে ভর্তি হন। এ সময় তিনি গ্রিক, লাতিন ও সংস্কৃত ভাষা আয়ত্ত করেন। মধুসূদন কর্মজীবনে প্রথমে মাদ্রাজের একটি অনাথ আশ্রমে শিক্ষকতা পেশায় নিজেকে নিযুক্ত করেন। পরে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক ও মাদ্রাজের বিখ্যাত একটি দৈনিক পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। সে সময় মাদ্রাজের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ইংরেজি ভাষায় তাঁর বহু প্রবন্ধ এবং ১৮৪৯ সালে ‘দ্য ক্যাপটিভ লেডি’ ও ‘ভিশনস অব দ্য পাস্ট’ নামে দুটি ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায়।
১৮৫৬ সালে মধুসূদন আবার ফিরে এলেন কলকাতায়। এখানে জীবন টিকে রাখার জন্য অনেক বিচিত্র পেশায় তাঁকে নিয়োজিত হতে হয়। প্রথমে পুলিশ আদালতের করণিক ও পরে তিনি দোভাষীরূপে চাকরি নেন। ১৮৬২ সালে কিছুকাল তিনি হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা সম্পাদনারও কাজ করেন। পরে তিনি ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলেত যান। ১৮৬৩ সালে তিনি সপরিবারে ফ্রান্স চলে যান। সেখানে তিনি তীব্র অর্থ সংকটে পড়েন। এ বিপদে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁকে অর্থ সাহায্য করেন। ১৮৬৬ সালের শেষ দিকে তিনি লন্ডনের গ্রেজ ইন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেন। ১৮৬৭ সালের জানুয়ারি মাসেই তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত নাট্যকার হিসেবেই প্রথম বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ করেন। রামনারায়ণ তর্করত্নের নাটক রত্নাবলীর ইংরেজি অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যে উপযুক্ত নাটকের অভাব অনুভব করেন। তাই ১৮৫৯ সালে তিনি রচনা করেন নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’। এটিই প্রকৃতপক্ষে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক নাটক। ১৮৬০ সালে তিনি রচনা করেন দুটি প্রহসন ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ও ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ এবং পূর্ণাঙ্গ ‘পদ্মাবতী নাটক’। এই ‘পদ্মাবতী’ নাটকেই তিনি প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন। ১৮৬০ সালেই তিনি অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখেন ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’। এর পর একে একে রচিত হয় ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্য, কৃষ্ণকুমারী নাটক, বীরাঙ্গনা কাব্য, ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’।
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহাকাব্য হিসেবে স্বীকৃত। এই মহাকাব্যের অনন্য ভাষাভঙ্গি, ছন্দরীতি ও কাব্যশৈলীর জন্য মধুসূদন চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি বাংলায় যে নতুন ছন্দ প্রবর্তন করেছেন, তা বাংলা সাহিত্যকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে। মাইকেল মধুসূদন দত্তই বাংলায় প্রথম সনেট ‘চতুর্দশপদ’ রচনা করেন। এ উপলক্ষে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে কবির জন্মস্থান সাগরদাঁড়িতে গত ২১ জানুয়ারি থেকে চলছে সপ্তাহব্যাপী মধুমেলা।
মাইকেলের শেষ জীবন চরম দুঃখ-কষ্টের মাঝে অতিবাহিত হয়েছে। দারিদ্র্য তাকে কুঁরে কুঁরে খেয়েছে। আইনজীবী হয়েও তিনি আইন ব্যবসায় সফল হতে পারেননি। ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত না-ফেরার দেশে পাড়ি জমান।
লেখক : কেশবপুর (যশোর) প্রতিনিধি, এনটিভি।