বস্তিতে আগুন
বড়লোকের ঢাকায় গরিব যাবে কই?
কড়াইল বস্তিতে আবার আগুন লেগে প্রায় সব বাড়িঘর পুড়ে ছারখার হলো। কত মানুষের জীবনে আঘাত লাগল আমরা জানতে পারব না। কিন্তু কড়াইলে আগুন লাগাটা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গরিব মানুষের ঘরে আগুন লাগলে আমাদের খুব একটা কষ্ট হয় না। তাদের জীবনটা আমাদের চেয়ে এতটা ভিন্ন ও দূরের যে মনে হয় অন্য কোনো গ্রহের মানুষের ঘরসংসার পুড়ে গেছে, আমরা ঠিকই আছি। এই নিরাপত্তাহীনতা, এই নিয়মিত আগুন লাগা প্রশ্নবিদ্ধ করে— বাংলাদেশের কে নাগরিক আর কে নাগরিক নয়। যদি বলি যে গরিব মানুষ পূর্ণ নাগরিকত্ব ভোগ করে না, কারণ স্বাভাবিক অধিকারগুলো তার জীবনে নেই তাহলে এর বিপক্ষে কী যুক্তি দাঁড় করাবেন।
২. ঢাকা শহরে আগুন লাগাটা প্রতিদিনকার ব্যাপার। আগে এত আগুন লেগেছে বলে মনে পড়ে না। মহাখালী এলাকাতেই সাততলা বস্তি ও কড়াইলসহ আগুন লাগল কয়েকবার। আমরা বেশ নীরব থাকতে শিখে গেছি। আলোচনাতেও আনি না। কারণ এর পাশাপাশি যেসব ঘটনা ঘটে সেসব আমাদের অনেক বেশি চিন্তিত করে। আমরা রাজনীতি এবং জঙ্গিবাদ নিয়ে অনেক বেশি ভাবি। কিন্তু গরিব মানুষের ঘরবাড়ি, রুজি-সংসার পুড়ে গেলেও আমরা খুব একটা ফিরে তাকাই না।
৩. গত মার্চে যখন আগুন লেগেছিল, তখন বিভিন্ন সংস্থা কড়াইলের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করেছিল। কিন্তু তিন মাস পরেই আগুন লেগে সব পুড়ে সাফা হয়ে গেছে। এবার দেখতে হবে কে তাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। যদি না আসে, তাহলে বস্তিবাসীর কী হবে। যদি আসে তাহলে আর কতবার তারা আসবে? কড়াইল বস্তির বাসিন্দারা মনে হয় একটা খেলার পুতুলে পরিণত হয়েছে। দেখছি, খাওয়াচ্ছি, ছুড়ে ফেলে দিচ্ছি, আগুন লাগিয়ে দিচ্ছি, কেউ বলার নেই। গরিবের আর যাই হোক বাপ-মা থাকে না— এটা প্রমাণ করার এত ব্যাপক চেষ্টা সহজে দেখা যায় না।
৪. ধরা গেল তর্কের খাতিরে যে ইচ্ছা করে কেউ দিয়াশলাই জ্বালিয়ে এতে আগুন দেয়নি। কিন্তু এটা তো অস্বীকার করে লাভ নেই যে এই বস্তি উঠে গেলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে এই জমির মালিক এবং সেটি সরাসরি হচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। গত মার্চ মাসে যখন আগুনে পুড়েছিল, তখন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সুনির্দিষ্ট খবর এসেছিল যে এখানে একটি আইটি পার্ক করা হবে এবং এটা নিয়ে বেশ আলোচনাও চলছিল। এখন যদি কেউ বলে যে যতবার বস্তিতে আগুন লাগবে, বস্তিবাসীর টিকে থাকার ক্ষমতা কমবে এবং একসময় তারা চলে যেতে বাধ্য হবে তাহলেও বস্তির আগুন লাগা কি পরোক্ষভাবে সরকারের জন্য সুবিধাজনক নয়? সরকার তো চাইলে ব্যবস্থা করতে পারে পুনর্বাসনের। কিন্তু সেটা না করে চুপ করে বসে থেকে কী প্রমাণ হচ্ছে।
সবার জানা যে গুলশান-বনানী এলাকাতেই প্রচুর দুই নম্বরি মালিকানা এবং বেআইনি দখল করা বাড়িঘর রয়েছে। একটি লাল মাথাওয়ালা অট্টালিকা তো কড়াইলের পাশেই অবস্থিত, তাদের তো সরকার কোনো দিন চলে যেতে বলেন না। গরিবের দিকে সরকারের এত সুনজর কেন ঠিক বোঝা যায় না।
৫. এই কড়াইল বস্তিকে ওঠানোর জন্য মামলা এবং উচ্ছেদ অভিযান হয়েছে ২০১২ সালে। বস্তিবাসী যখন রাস্তায় নেমে এসে অবরোধ করে, কেবল তখনই এই অভিযান বন্ধ হয়। এরপর একটি মামলার মাধ্যমে উচ্ছেদের আদেশ স্থগিত করা হয়। কিন্তু সরকার তো বড়লোকের বেআইনি সম্পদ উদ্ধারের ব্যাপারে তেমন কোনো আগ্রহ দেখায় না, কেন? বাংলাদেশের ব্যাংকের দুই নম্বরি ঋণ আর এক নম্বর চুরির টাকা যদি হিসাব করা হয়, তাহলে কতগুলো কড়াইল বস্তি পুনর্বাসন করা সম্ভব সেটার হিসাব কি সরকার কোনো দিন করেছে? অতএব পুরো ব্যবস্থাটাই চলে গেছে গরিবের বিরুদ্ধে। এ কারণে ঢাকা শহরের গবিরদের মেরে-পিটিয়ে, আগুন দিয়ে শায়েস্তা করে রাখা হয়। যাতে প্রতিবাদের কণ্ঠ না ওঠে।
আদালত জানিয়েছেন যে ২০০৬-২০০৮-এর সময় যেসব টাকা মিলিটারি সরকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জরিমানা করেছিল, সেই সব ফেরত দিতে হবে, এই টাকার পরিমাণ প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি। এটা বড়লোকদের জন্য সুসংবাদ, তাদের কোটি কোটি টাকা আছে সেটা আরো বাড়বে কিন্তু গরিবদের জন্য পাওনা টাকা কই? বড়লোক করার যে মেশিন, যার নাম বাংলাদেশ বিশেষ করে ঢাকা শহর সেখানে প্রান্তিক গরিবের মাসিক গড় আয় আট হাজার টাকা আর ওপর তলার অবস্থাপন্ন লোকদের মাসিক গড় আয় তিন লাখ টাকা। একটা দেশের আর্থসামাজিক বৈষম্যের এর চেয়ে ভালো চিত্র দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়।
ঢাকা শহরে থাকবে কেবল বড়লোক, গরিবের কোনো স্থান নেই। এটা ঠিকই আছে। তাহলে গরিবদের ঘরে নিয়মিতভাবে আগুন না লাগিয়ে, উচ্ছেদ অভিযান না চালিয়ে রুজি আর দোচালা ঘর ওঠানোর ব্যবস্থা করে দিলেই তো হয়।
মার্চ আর ডিসেম্বর আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠ দুই মাস। একটি স্বাধীনতার, অন্যটি বিজয়ের। এই দুই মাসেই কড়াইল বস্তি আগুনে পুড়ে শেষ হলো দেখে এক অদ্ভুত প্রতীকের দিকে তাকিয়ে আছি আমরা মনে হয়। ঘটনায় বোঝা যায়, দেশটা কার হাতে আছে আর কার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
আমি কোনো দিনই বিশ্বাস করব না যে গোপালগঞ্জের সেই দীর্ঘদেহী মানুষটির স্বপ্নের বাংলাদেশে গরিবের এত কষ্ট হওয়ার কথা ছিল।
লেখক : গবেষক ও সাংবাদিক