স্মরণ
ভাওয়াইয়ার অনন্য সাধক
চাঁদ কত মায়াময়। কতভাবে চাঁদ যে কতজনের কাছে এসে ধরা দেয়, কত বন্দনা, কত কবিতা-গান এই চাঁদকে নিয়ে-যা শেষ হওয়ার নয়। চাঁদের প্রতি এই ভালোবাসা-ভালোলাগা যেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে সবার কাছে। তেমনি এই মায়াময় চাঁদের মতোই আমার গুরুজি নুরুল ইসলাম জাহিদ। কি শিল্পী হিসেবে, কি ব্যক্তি মানুষ হিসেবে- এক অসাধারণ মানুষ তিনি। যেমন গায়কিতে ভিন্নতা, গান লেখার ক্ষেত্রে-শব্দ চয়নে ও সুরে ভিন্নমাত্রা এবং বিষয় নির্বাচনে দারুণ বৈচিত্র্যতা, তেমনি চাঁদের নরম আলোর মতো মায়াবী আর বিশাল মনের মানুষ তিনি। কোনো মানুষকে আহত করে কথা বলার একটি উদাহরণও যাঁর জীবনে নেই।
ঠিক যেন তিনি চাঁদের মতোই সবকিছুর ঊর্ধ্বে সবার কাছে লোকসংগীতের অন্যতম ধারা ভাওইয়ালোক আকাশে। সব মিলে সৃষ্টিশীল, বৃহৎ মনের বহুমাত্রিক এক শিল্পীর নাম নুরুল ইসলাম জাহিদ। তিনি ভাওয়াইয়ার কিংবদন্তি, সাড়ে তিন হাজার গানের গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী। ভাওয়াইয়া গানের পাশাপাশি তিনি লিখেছেন অসংখ্য আধুনিক, পল্লীগীতি, মারফতি, মুর্শিদী, ভাটিয়ালি ও দেশের গান। মুক্তিযুদ্ধেও ছিল তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ।
মানুষ, দেশ, প্রকৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি নিবেদিত এই মানুষটির যে কত গভীর ভালোবাসা তা তাঁর রচনায় স্পষ্ট। যার লেখা প্রাণ ছোঁবেই, মন কাড়বেই।
মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যেসব ঘটনা বা বিষয় থাকে তার সবকিছুই তুলে এনেছেন ছন্দবদ্ধ করে নিজের রচনায়। আর এসব রচনায় সৃষ্টিকর্তার কাছে দেশবাসীর মঙ্গল কামনা করে গান, প্রেম, রোগ-শোক, ঈদ-পূজা, পার্বণ, জাতীয় বিশেষ দিন, বিয়ে, বসন্ত, নবান্ন, কৃষি, জাতীয় ব্যক্তিত্বদের নিয়ে রচিত গানসহ বিভিন্ন বিষয়ে অসংখ্য গান লিখেছেন তিনি। যাঁর রচনায় সামান্যতম অশ্লীলতার ছোঁয়া নেই। আর এসব রচনায় দিয়েছেন মিষ্টি সুর, তা পরিবেশন করেছেন মনকাড়া ভিন্ন এক গায়কিতে। উত্তরাঞ্চলের মাঠ-ঘাট, প্রান্তর, আনাচে-কানাচে এখনো যাঁর সুর ভেসে বেড়ায় কিষান-কিষানি, প্রেমিক হৃদয়, গৃহবধূ, মা-বোনদের মনের খোরাক জোগায় তাঁর গান। যাঁর গান এখনো হাসায়, কাঁদায় এবং উজ্জীবিত করে সাধারণ মানুষকে। আজ ১ এপ্রিল এই মহান মানুষটির দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। দীর্ঘ চার বছর রোগভোগের পর ২০১৫ সালের ১ এপ্রিল গুণী এই মানুষটি চলে গেছেন নানা ফেরার দেশে।
দেখতে দেখতে দুটি বছর পেরিয়ে গেল অথচ একটিবারের জন্যও মনে হয়নি গুরুরি শারীরিকভাবে বেঁচে নেই। অন্তত আমার মতো অধম এক শিষ্যের কাছে গুরুজি নুরুল ইসলাম জাহিদ এক জীবন্ত কিংবদন্তি। আমি একজন ক্ষুদ্র শিল্পী হিসেবে বেতার-টিভি-চ্যানেলে সংগীত পরিবেশন ছাড়াও মঞ্চে কিংবা বাসায় গান পরিবেশন বা চর্চায় প্রতিমুহূর্তে বড্ড অনুভব করি তাঁকে। সময়-অসময়ে, দুঃখে-আনন্দে ফিরে যাই তাঁর গানের কথা ও সুরে। যাঁর গানের কথা দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে আমায়।
ভাওয়াইয়ার প্রচলিত ধারার গানগুলোতে সুর ও কথার ঐজ্জ্বল্য রয়েছে। প্রচলিত গানগুলো দীর্ঘস্থায়ী জনপ্রিয়তা পেলেও শিক্ষিত গীতিকারদের অবদান কম নয়। সে ক্ষেত্রে রচয়িতা হিসেবে নুরুল ইসলাম জাহিদের বিশেষ কৃতিত্ব রয়েছে। শব্দ ও সুরের নির্বাচনে তাঁর পারদর্শিতা অনস্বীকার্য। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সংসারের টানাপড়েন ও অসঙ্গতিগুলো সহজেই উঠে এসেছে তাঁর গানে। তবে যে বিশেষ অঞ্চলিক শব্দের বহুল ব্যবহার অনেক সময় এই ধারার গানকে দুর্বোধ্য করে তোলে-সেসব শব্দের ব্যবহার নিতান্তই কম। শ্রোতাকে আকৃষ্ট করে তাঁর কথার সারল্য। সরল বাণী বিন্যাসের মধ্য দিয়েই বিভিন্ন পেশার মানুষ যেমন-মাঠের চাষি, গাড়িয়াল বন্ধু, নারীর প্রেম ও দীর্ঘশ্বাস তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। তাঁর গানের কথায় আছে-
“এই যে ইট বিছিয়া বান্ধিছে ঘাটা
গরুর গাড়ীত মটরের চাকা
হিড় হিড় করিয়া কি সুন্দর দৌড়ায়
বাহে দারুন আরাম হইছে এলা আরো গাড়িয়ালী ব্যবসায়।”
ভাষার সারল্যে জীবনের পরিবর্তনের কথা সহজেই অনুমেয়। কাঁচা রাস্তা থেকে ‘ইট বিছানো রাস্তা’ কিংবা কাঠের চাকার পরিবর্তে টায়ারের চাকা লাগানো-এই অনিবার্য রূপান্তর চিত্রায়ণে গীতিকার নুরুল ইসলাম জাহিদ আপন দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর রচনায় ভিন্নতর আস্বাদ মেলে-যেমন একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, পয়লা বৈশাখ প্রভৃতি বিষয়ভিত্তিক গানে। ইতিহাস-ঐতিহ্যেও তথ্যনিষ্ঠ চিত্র পাওয়া যায় এসব রচনায়। যেমন-ভাষা শহীদদের নিয়ে লিখেছেন-
“অ আ ই ঈ ক খ গ ঘ ঙ
রক্তে লেখা আছে ইহা
মিশবে না কখনো
তোমরা জানো কিনা জানো
না জানিলে জগতবাসী
শোনো বলি শোনো ॥
পাগলের পাগলামী নিয়া পাগল আইলো দেশে
মায়ের ভাষা ছাড়তে বলে ভাল মানুষের বেশে
দেশবাসী দিল বাঁধা পাগলের কথায়
তাইনা শুনে মোদের বুকে বন্দুক চালায়
ও মরি হায়রে হায় আমার কইতে দুঃখ হয়
দেশবাসীর রক্তে দেশে নদী বইয়া যায় ॥”
আমাদের বিজয় দিবসকে নিয়েও অসাধারণ কিছু গান লিখেছেন। তার একটির কথা এমন-‘বিজয়ের দিনতে আইসো সবাই মিলি ধরি গান/ পর আপন ভুলিয়া আইসো একসাথে গাই বিজয়ের গান ॥” জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নুরুল ইসলাম জাহিদের লেখা ও গাওয়া অনেক গান শুনেছি রংপুর বেতার থেকে। যেমন-“জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাংলার নয়ন মণি/ভুলি নাই ভুলিব না ভাই / আমরা তার মুখের বাণী ॥”
বৈশাখে শুনেছি “এ বছর যেন সুখে থাকি রে / শোন শোন দয়াময় / ওরে হাসিয়া খেলিয়া যেন মোর দেশবাসী কাটায় ॥” কিংবা “আইজ আইলোরে বছর ঘুরি বৈশাখের পৈলা দিন/ ওরে নাচো আর গান গাও /তালে তালে ঢোল বাজাও তাক্ ধিনা ধিন্ ধিন তাক্ তাক্ / তাক্ ধিনা ধিন্ ধিন ॥”
তার নবান্নের লেখা গানেরও জুরি নেই। যেমন-“কয়সার আলো চাউল পাড়িয়ে সোনা মোর বানিয়ে করো আটা/কাইল বিয়ানে বানেয়া দেন মোক গামলা কয়েক পিঠা/ওকি হায়রে হায় মনটায় মোর পিঠা খাবার চায়”-এই গানটিসহ তিনটি গান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘উত্তরের সুর’-এ ব্যবহৃত হয়েছে। নাটকেও বেশ কয়েকটি গান ব্যবহৃত হয়েছে।
কালা, গাড়িয়াল কিংবা গাড়িয়াল বন্ধুর প্রেম বিরহের একঘেয়েমি ছক বাঁধা গান থেকে এসব গান ভিন্ন স্বাদের। যা ভাওয়াইয়ার পরিধিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। লোকসংস্কৃতির ভাণ্ডারকে করেছেন সমৃদ্ধ। এসব বিষয়ে গুরুজির সঙ্গে বহুবার কথা বলতে গিয়ে জেনেছি। তা ছাড়া বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও বেতারে দেওয়া সাক্ষাৎকার শুনে জেনেছি যে-এই এক ঘেয়েমি ছক তথা বৃত্ত ভাঙতে গিয়েই গীতিকার হিসেবে তাঁকে অনেক বিতর্কের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তিন প্রথম রংপুর বেতারে ঈদ, পূজা, নবান্ন, পিঠা, বৈশাখসহ বিশেষ দিনগুলো নিয়ে ভাওয়াইয়া রচনা করেন এবং তা সুর দিয়ে বেতারে পরিবেশন করেন। শিল্পী, সুরকার ও গীতকার পরিচয়ের পাশাপাশি তিনি লোকগানের একজন নিবিষ্ট গবেষক। ঐতিহ্য ও লোকসংগীত বিষয়ে তাঁর লেখাও কম নয়। বিভিন্ন পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকার এবং ‘গ্রাম বাংলার চিরায়ত সংগীত-পল্লীগীতি’, ‘কুড়িগ্রাম হামার জেলা বাহে’ প্রভৃতি লেখায় পল্লীজীবন ও পল্লীগানের নিষ্ঠাবান গবেষক সত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
আশির দশকে রংপুর বেতার কর্তৃপক্ষের আয়োজনে ‘নানা কারণে ভাওয়াইয়া গানের স্বকীয়তা ও জনপ্রিয়তা হারিয়ে যেতে বসেছে। সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও উত্তরণ’ শীর্ষক বিশেষ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় ভাওয়াইয়ার একজন গবেষক হিসেবে নিজের লেখা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তাঁর এই বক্তব্যে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গেই বলতে পেরেছিলেন গীতিকারদের চৌর্যবৃত্তির কথা ও সুরকারদের সুর বিকৃতির কথা। প্রচলিত গানের দু-একটি কলি পরিবর্তন করে, পুরোনো গানের ছাঁচে ফেলে গীতিকার সাজার অপচেষ্টার কথা অকপটে তুলে ধরেন। কম পারিশ্রমিকের কারণে শিল্পী ও গীতিকারের গভীর পরিচর্চা পাওয়া অসম্ভব। ওই দিন আরো অনেক যৌক্তিক দাবি তুলে ধরেছিলেন প্রাণের গান ভাওয়াইয়াকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠার তাগিদ থেকেই। তাঁর দেওয়া প্রতিটি দাবি ও অভিযোগ আজও প্রাসঙ্গিক। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, নুরুল ইসলাম জাহিদের কোনো দাবি তথা অভিযোগ রংপুর বেতার কর্তৃপক্ষ আজও খতিয়ে দেখেনি কিংবা কোনো দাবি সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধেও মানুষটির ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। মুক্তিযুদ্ধের সময় কুচবিহারের Welfare Centre for Evacuee Children- নর্থ বেঙ্গল জোন থেকে প্রশিক্ষণ শেষে ক্যাম্পে ক্যাম্পে নিজের লেখা ও সুরারোপিত গান শুনিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেছেন। সুন্দর হস্তাক্ষরে লিখেছেন পোস্টার। তাঁর সহযোদ্ধারা যুদ্ধ শেষে সার্টিফিকেট গ্রহণ করলেও যিনি মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।
নুরুল ইসলাম জাহিদের পরিবারটি এখন বিধ্বস্ত। স্ত্রী মিসেস হামিদা জাহিদ তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বামীর নামটি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় রাখা হোক— এই দাবি নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে অবশেষে আশাও ছেড়ে দিয়েছেন। একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উৎকোচ হিসেবে চেয়েছেন ১০ লাখ টাকা। হায় দেশ!
গুরুজির দ্বিতীয় প্রয়াণ দিবসে ‘ভাওয়াইয়া’ গানের দল এবং আমাদের প্রথম দাবি— জীবদ্দশায় না পেলেও এখন মরণোত্তর একুশে পদক দেওয়া হোক, দ্বিতীয়ত. তিনি যে একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তার স্বীকৃতি দেওয়া হোক, তৃতীয়ত. রংপুর বেতারে রেকর্ডকৃত সাড়ে তিন হাজার গানের অধিকাংশই কে নষ্ট করল তা খুঁজে বের করা হোক। চতুর্থত. আগামী প্রজন্মকে জানাতে অন্যান্য কৃতী সন্তাদের মতো নুরুল ইসলাম জাহিদের ছবিও রংপুর বেতার কেন্দ্রে ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকায় সংরক্ষণ তথা দেয়ালে ঝুলানো হোক এবং পঞ্চম দাবি হচ্ছে বাংলা একাডেমির মাধ্যমে তাঁর সাড়ে তিন হাজার গানের পাণ্ডলিপি কয়েক খণ্ডে বই আকারে প্রকাশ করা হোক। জানি না আমাদের এই দাবিগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কানে পৌঁছাবে কি না?
এমন নির্লোভ, স্বভাব কবি, গুণী মানুষের শিষ্য হতে পেরে সত্যিই গর্ববোধ করি। আজ গুরুজির একটি জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া গানের কথা খুব মনে পড়ছে-‘উড়িয়া দেখিস কুড়িয়ারে তুই দূর দূরান্তর / ঘুরিয়া ফিরিয়া দুনিয়া দেখিস / দেখিস কি অন্তর’।
গুরুজি আপনার পোড়া অন্তরের ব্যথা আমরা বুঝতে পাই, নিশ্চয়ই এই দেশ-এই সমাজ একদিন বুঝবে! অন্তত এটুকু বলতে পারি-আপনার সৃষ্টি হাজার বছর বেঁচে থাকবে।
শেষে এটুকুই বলতে চাই, চাঁদের মতোই মায়াময় আর সাদা মনের যে মানুষটি দেশের জন্য, মানুষের জন্য পুরো জীবনটা কাটিয়ে দিলেন; এককথায় নিঃশেষ করে দিলেন- তাঁর জন্য এই দেশ, এই সমাজের কি কিছু করার নেই?
লেখক : ভাওয়াইয়া শিল্পী ও সাংবাদিক; প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, ‘ভাওয়াইয়া’ গানের দল এবং ‘ভাওয়াইয়া স্কুল’, চেয়ারম্যান- কলতান সাংস্কৃতিক একাডেমি।