অভিমত
হেফাজত-রাজনীতি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সমাজনীতি অনেকের চেয়ে ভালো বোঝেন মনে হয়। যে কারণে তাঁকে রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করেও খুব একটা সফল হচ্ছে না তাঁর বিরোধী পক্ষ। তাঁর বিভিন্ন সিদ্ধান্ত সবই জনগণের স্বার্থে যাচ্ছে তা এমন নয়, কিন্তু তাঁর প্রতিপক্ষ তাঁকে কাত করতে পারছে না। তাঁর জঙ্গিবাদবিরোধী ও হেফাজতপন্থী নীতি তার প্রমাণ।
২. হলি আর্টিজান বেকারি আক্রমণের আগে সরকার কোনো জঙ্গিবাদবিরোধী ভূমিকা তেমন নেয়নি। কিন্তু বেকারি হামলা সরকারের ক্ষমতা ও ভাবমূর্তির প্রতি একটা হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এর পরেই জঙ্গিবাদবিরোধী কার্যক্রম শুরু হয় এবং এই ঝগড়া-ঝাঁটিতে জঙ্গিবাদীরা ভীষণভাবে পর্যুদস্ত।
অত্যন্ত কঠোর হাতে তারা কার্যক্রম চালাচ্ছে ক্রসফায়ারসহ। এই নির্মূল অভিযানে সরকার মানবাধিকার রক্ষা করেছে কি করেনি সেটা নিয়ে কারো চিন্তায় আসেনি। সেই দিক থেকে জঙ্গি দমন কৌশল হিসেবে এটা সফল।
৩. বেশ কিছু দিন ধরেই সরকারের হেফাজত তোষণনীতির সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু সরকার এতে চিন্তিত- এমন বলা যায় না। বিএনপি যখন ক্ষমতা দখল করতে চেষ্টা করেছিল, হেফাজতের ঢাকা অভিযানের মাধ্যমে তখন সরকার সেটা ব্যর্থ করে দেয়। কিন্তু সরকার পরবর্তী সময়ে আর হেফাজতের বিরুদ্ধে কোনো অভিযান চালায়নি, যার ফলে সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছে দুজনের মধ্যে। তা ছাড়া হেফাজত বিএনপির নাগালের বাইরে চলে গেছে। রাজনৈতিক দিক থেকে এটি আওয়ামী লীগের জন্য লাভজনক। এই অবস্থানটা হাসিনা কেন নিল?
৪. হাসিনা যেমন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দিয়েছে, ঠিক একইভাবে দূরত্ব বজায় রেখেছে ব্লগারদের কাছ থেকে। যাঁদের কেউ কেউ ধর্মের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করে। অর্থাৎ হাসিনা মূলধারার সঙ্গে থাকতে চান, যেটি প্রধানত ধার্মিক জনগোষ্ঠী দ্বারা গঠিত। সে কারণে এটাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে তাঁর দল হেফাজতের সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতা করবে।
হাইকোর্টের সামনে থেকে হাসিনা ‘মূর্তি’ সরালে অনেকে ক্ষুব্ধ হবেন, কিন্তু খুশি হবেন তাঁর চেয়েও বেশি। গত ২০ বছরে গ্রামে একটি তুলামূলকভাবে সবল মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয়েছে। তাদের ওপর হেফাজত ও তরীকতের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের প্রভাব অনেক বেড়েছে। এতে কেবল জামায়াত-বিএনপির আদর্শগত প্রতিপক্ষই তৈরি হয়নি, সরকারি দলকেও সবল করেছে। সেই কারণেই হাসিনা কোনো কাজই করবেন না যাতে মনে হতে পারে তাঁর সহানুভূতি ধর্মপন্থীদের বাইরে যায়।
৫. হাসিনা শিক্ষা পেয়েছে সম্ভবত শাহবাগ আন্দোলন থেকে, যেটি ছিল সাম্প্রতিককালের বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। কিন্তু লক্ষণীয় যে, এটি প্রধানত ঢাকাকেন্দ্রিক এবং খুব মোটা দাগে ‘উদার ও সেক্যুলার’ ছিল, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হওয়াসহ। অথচ এই আন্দোলনকে কেবল ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে এর শত্রুরা ঘায়েল করে দিল খুব স্বল্প সময়ে। সে কারণে উদার মধ্যবিত্ত আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাটা পরিষ্কার।
সরকার ঢাকা থেকে হেফাজতকে খেদিয়ে দেওয়ার পরেও তার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে ও প্রয়োজনে তাদেরকে দিয়ে জনমত নিজের পক্ষে আনছে। নিজের টেকার স্বার্থেই হেফাজতও সরকারের ঘনিষ্ঠ থাকবে আর সরকারও জানে হেফাজত কতদূর দৌড়াতে পারবে। পরিস্থিতি দুজনের পক্ষেই সুবিধাজনক।
বাদ পড়ল কারা তাহলে? দুর্ভাগ্যবশত সেটি হচ্ছে ওই শাহবাগপন্থীরাই। অর্থাৎ উদার মধ্যবিত্ত শ্রেণি যেটি প্রধানত ঢাকাকেন্দ্রিক। এরা সংখ্যায় বড় না হওয়ার ফলে রাজনীতিতে প্রয়োজন অনেকটাই কম এখন। তাই নির্বিবাদে হাসিনা এদের নিয়ে এতটা চিন্তা করছেন না মনে হয়।
৬. রাজনীতি আদর্শের বিষয় না, ক্ষমতায় টিকে থাকার বিষয়। আওয়ামী লীগ তার সমর্থনের পরিসর অনেক বড় করেছে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে। তবে তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ‘হেফাজতকে’ নিজের হেফাজতে রাখা। পয়লা বৈশাখ সরকারিভাবে পালন যদি সফল হয়, বিনা ঝামেলায় হাসিনার সাবল্য বৃদ্ধি পাবে আরো। পূর্বেকার একক ক্ষমতার মডেল এখন আর নেই, তাই নানা ধরনের জোট সৃষ্টি হচ্ছে। সেটা আন্তর্জাতিকই অথবা জাতীয়। এই জোটের সমীকরণে হেফাজত আওয়ামী লীগের বন্ধুতে পরিণত হয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক