দৃষ্টিপাত
অভিনন্দন এরশাদ!
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতির রহস্যময় চরিত্রগুলোর অন্যতম। টানা নয় বছর স্বৈরশাসকের তকমা নিয়ে দেশ শাসনের পরে গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত এবং তারপর দীর্ঘদিন জেলখানায় কাটানোর পর সেই সাবেক স্বৈরশাসকই পরবর্তীকালে ভোটের রাজনীতির অন্যতম ফ্যাক্টর, এমনকি দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক সরকারের প্রধানমন্ত্রীরও বিশেষ দূত।
বন্দুকের নলে ক্ষমতা দখলের পর ক্ষমতাচ্যুত হয়েও রাজনীতিতে এমন প্রতাপের সঙ্গে টিকে থাকার সৌভাগ্য পৃথিবীর আর কোনো সামরিক শাসকের ভাগ্যে জুটেছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তো, সেই এরশাদ যখন সেনাবাহিনীর প্রধান, অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি হননি, তখনকার একটি বহুল আলোচিত মামলায় আদালত তাঁকে খালাস দিয়েছেন। ১৯ এপ্রিল বুধবার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. কামরুল হোসেন মোল্লাহ এই রায় দেন। যেখানে আদালত বলেছেন, মামলার গুরুত্বপূর্ণ নথি ও সাক্ষীদের হাজিরে ব্যর্থ হয়েছে প্রসিকিউশন। আমরা স্মরণ করতে পারি, প্রসিকিউশনের ব্যর্থতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালও। নানা সমালোচনার মুখে প্রসিকিউশনে পরিবর্তনও আনা হয়।
একটি মামলার রায় কী হবে, তা নির্ভর করে পুলিশের রিপোর্ট এবং পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ ও সাক্ষী হাজিরের ওপর। অপরাধ যত বড় এবং যত নৃশংসই হোক না কেন, প্রসিকিউশন যদি সেটি প্রমাণ করতে না পারে, আদালতে যদি তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপনে ব্যর্থ হয় এবং সাক্ষীরা যদি সাক্ষ্য না দেয়, তাহলে সেই মামলার আসামিদের সাজা দেওয়া কঠিন। সুতরাং রাডার ক্রয়ে এরশাদ দুর্নীতি করেছেন, এখন আর এ কথা বলার সুযোগ নেই। কারণ, বিচারক তাঁকে খালাস দিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি আদালত কর্তৃক নির্দোষ প্রমাণিত, যদি না আপিলে তিনি দোষী প্রমাণিত হন।
১৯৯২ সালের ৪ মে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো এরশাদের বিরুদ্ধে রাডার ক্রয়ে দুর্নীতির যে মামলা করে, সেখানে বলা হয়েছে, তৎকালীন বিমানবাহিনীপ্রধান সদর উদ্দিন আহমেদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কাছে বাহিনীর জন্য যুগোপযোগী রাডার ক্রয়ের আবেদন করেন। রাষ্ট্রপতির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় ফ্রান্সের থমসন সিএসএফ কোম্পানি নির্মিত অত্যাধুনিক একটি হাই পাওয়ার রাডার ও দুটি লো লেভেল রাডার ক্রয়ের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। কিন্তু সেনাপ্রধান এরশাদসহ অপর আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে আর্থিক সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে থমসন সিএসএফ কোম্পানির রাডার না কিনে বেশি দামে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্টিং কোম্পানির রাডার কেনেন। এতে সরকারের ৬৪ কোটি চার লাখ ৪২ হাজার ৯১৮ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়। ঘটনার এক দশক পরে মামলা এবং তারও ২৫ বছর পরে ঘোষিত রায়ে খালাস পেলেন এরশাদ। এটি তাঁর জন্য একটি বড় বিজয়, কিন্তু পক্ষান্তরে আমাদের বিচারব্যবস্থার জন্য একটা বড় শিক্ষা।
২.
এরশাদ সম্পর্কে রাজনীতিতে যত কথা প্রচলিত, তার মধ্যে একটি এ রকম যে এরশাদ সকালে যা বলেন, বিকেলে তা বদলে ফেলেন। রাতে শোনা যায় নতুন কথা। ১৯৮২ সালে তৎকালীন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের সঙ্গে ‘অভিনয়’ করে খলনায়ক হিসেবে যাত্রা শুরু তাঁর। রাষ্ট্রপতিকে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিন মাস পর এরশাদ নিজেই ক্ষমতা দখল করেন।
১৯৯০ সালের ১ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়ার ঘোষণা দিয়েও পরের ছয় দিন পর্দার আড়াল থেকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে সব ধরনের চেষ্টা করেন। তাঁর পতনের পর বিএনপি ক্ষমতায় এলে কারাগারে যেতে হয় তাঁকে। ১৯৯৭ সালের জানুয়ারিতে কারাগার থেকে মুক্তির পর বড় দুই দলের সঙ্গেই তিনি করেছেন মন বদলের নাটক।
ছিয়ানব্বই সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করে ক্ষমতার শরিক হয় জাতীয় পার্টি। যদিও তিন বছরের মধ্যেই সেই সম্পর্ক ভেঙে যায়। আওয়ামী লীগকে ছেড়ে চারদলীয় জোট করেন বিএনপির সঙ্গে। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো সক্রিয় হওয়ায় সেই জোট থেকে মাত্র এক বছরের মাথায় বেরিয়ে আসেন। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সমঝোতা করেন।
২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত চারদলীয় জোটের শাসনামলের পুরো সময় ‘নখদন্তবিহীন’ বিরোধী দলের ভূমিকায় ছিলেন এরশাদ। সরকারের সমালোচনা কিংবা প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে সখ্য কোনোটিই করেননি। ২০০৭ সালের নির্বাচনের আগে অনুকূল পরিবেশ পেয়ে আবার স্বরূপে আবির্ভূত হন। বিএনপির সঙ্গে জোট গঠনের আশ্বাস দিয়েও যোগ দেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটে।
দেশে জরুরি অবস্থা জারি হলে প্রধান দুই দলের নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াসহ আরো বেশ কিছু শীর্ষ নেতা কারাগারে যান। কিন্তু বাইরে থাকেন এরশাদ। গা বাঁচাতে রাজনীতি থেকে অবসরেরও ঘোষণা দেন। দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব ছাড়েন। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে ঠিকই ফিরে আসেন। মহাজোটের শরিক হয়ে ক্ষমতার অংশ হন। আর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়ার দোলাচল, সকাল-বিকেল মত পাল্টানো এবং অবশেষে নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত—সব মিলিয়ে একটা সিনেম্যাটিক ব্যাপার, যা কেবল এরশাদের পক্ষেই সম্ভব।
তবে অনেকে মনে করেন, এরশাদের এই বারবার অবস্থান বদলানোর পেছনেও রয়েছে এই মামলাভীতি। তাঁর সাবেক স্ত্রী বিদিশা শত্রুর সঙ্গে বসবাস বইয়ের ১৫৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘আমি যত দিন এরশাদকে কাছ থেকে দেখেছি, মনে হয়েছে এই পৃথিবীতে জেলের চেয়ে বেশি ভয় সে আর কিছুকে পায় না। এমনকি আল্লাহর চেয়েও বেশি ভয় পায় জেলকে। শেখ হাসিনার কারণে তার দল ভেঙে গেছে, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আলাদা জাতীয় পার্টি করেছে—এ নিয়ে তার যতটা রাগ, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ক্রোধ জেলে নেওয়ার কারণে। একই কারণে তার রাগ দেখেছি খালেদা জিয়ার প্রতিও। জীবনে প্রথম এবং সবচেয়ে বেশি সময় জেল খেটেছে সে তার কারণে। অনেকবার আমাকে বলেছে সে এই কথা। সেই সঙ্গে জানিয়েছে তার একটি প্রতিজ্ঞার কথা। বলেছে, জীবনে যদি একদিনের জন্যও সুযোগ পাই, এর প্রতিশোধ আমি নেব। দুই মহিলার যাকেই আগে বাগে পাব, চরম শিক্ষা দেবো। আর আমার জীবনের কোনো ইচ্ছাই অপূর্ণ থাকেনি। হয়তো সময় লাগবে, কিন্তু সুযোগ আমি পাবই।’
আর এরশাদের এই জেলভীতিকে কাজে লাগিয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুদলই। অর্থাৎ এরশাদ যখনই বেঁকে বসেছেন, তখনই তাঁর বিরুদ্ধে চলমান মামলাগুলো চাঙ্গা করা হয়েছে। আবার এরশাদ যখন বাগে এসেছেন, তখন মামলার ফাইল চাপা দেওয়া হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে মঞ্জুর হত্যা মামলা এখনো বিচারাধীন। সুতরাং রাডার ক্রয় মামলায় খালাস পেলেও মঞ্জুর হত্যা মামলা নিয়েও এরশাদের মনে যথেষ্ট ভয় আছে। ফলে তাঁর ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতিপ্রকৃতি, বিশেষ করে ভোটের সময় দরকষাকষিতেও এই মামলা যে বড় ভূমিকা রাখবে, তা নিয়ে সন্দেহ কম।
প্রশ্ন উঠতে পারে, রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ মিলিয়ে কী বিচারকরা রায় দেন? তা নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু বিচারক কী রায় দেবেন, তা নির্ভর করে আসামির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন অপরাধ প্রমাণ করতে পারল কি পারল না এবং সাক্ষীরা যেসব সাক্ষ্য দিয়েছেন, সেখানে আসামির বিরুদ্ধে তাঁরা কী বক্তব্য দিয়েছেন এবং সেই বক্তব্যগুলো আদালতের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো কি না, তার ওপর। অর্থাৎ একটি ঘটনায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে কি না, তা নির্ভর করছে নির্বাহী ও বিচার বিভাগের যৌথ আন্তরিকতা ও সততার ওপর। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মামলার তদন্তভার থাকে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের ওপর। সুতরাং তারা যদি সঠিক তদন্ত না করে এবং সঠিক রিপোর্ট না দেয়, তখন বিচার বিভাগ যত স্বাধীনই হোক না কেন, তার পক্ষে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা কঠিন।
আমীন আল রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক।