প্রথাবিরোধী যোদ্ধা হুমায়ুন আজাদ
আমাদের দেশে যাঁরা প্রচলিত প্রথা ও অশালীন জড়তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেছেন, তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ অন্যতম। প্রথাবিরোধী ও বহুমাত্রিক মননশীল লেখক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ আমৃত্যু যুদ্ধ করে গেছেন প্রচলিত নানা অশালীন প্রথার বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশে নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেনের শত বছর আগেই বলা, ‘আপনারা হয়তো শুনিয়া আশ্চর্য হইবেন যে, আমি আজ ২২ বৎসর হইতে ভারতের সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট জীবের জন্য রোদন করিতেছি। ভারতবর্ষে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট জীব কাহারা জানেন? সে জীব ভারত নারী। এই জীবগুলোর জন্য কখনও কাহারও প্রাণ কাঁদে না।’ তাঁর এই কথাগুলোকে পুনর্জাগরণ ঘটান প্রয়াত হুমায়ুন আজাদ। তিনি তাঁর ‘নারী’ বইতে লিখেছেন আমাদের দেশের শৃঙ্খলিত নারীসমাজের কথা। নারী অধিকার নিয়েও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু অনেক পরিপাটি।
আজ বহুমাত্রিক এই লেখকের জন্মদিন। ১৯৪৭ সালের এই দিনে তাঁর নানাবাড়ি মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরের কামারগাঁওয়ে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৮ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর জন্মগত নাম হুমায়ুন কবীর পরিবর্তন করে তিনি বর্তমান নাম ধারণ করেন। তাঁর বাবা পোস্টমাস্টারির চাকরি ও ব্যবসায়ী ছিলেন এবং মা জোবেদা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। ১৯৯২ সালে তিনি বাবা হারান। ১৯৭৫ সালে হুমায়ুন আজাদ লতিফা কোহিনুরকে বিয়ে করেন। তাঁর দুই মেয়ে মৌলি আজাদ, স্মিতা আজাদ এবং এক ছেলে অনন্য আজাদ।
বর্ণপ্রথাবিরোধী ও বহুমাত্রিক এই লেখকের শিক্ষাজীবনও ছিল বিচিত্র। ছেলেবেলায় প্রখর মেধাবী হুমায়ুন আজাদ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে অধ্যয়নের পর তৃতীয় শ্রেণি বাদ দিয়েই সরাসরি চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন রাড়িখালের স্যার জে সি বোস ইনস্টিটিউশন-এ। এ প্রতিষ্ঠান থেকেই তিনি তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান সেকেন্ডারি এডুকেশন বোর্ডের অধীনে ১৯৬২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন (বর্তমানে মাধ্যমিক বা এসএসসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি এবং ১৯৬৮ সালে একই বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর প্রথম শ্রেণি পেয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানে বাংলা ভাষায় সর্বনামীয়করণ বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীকালে এই গবেষণাপত্র ১৯৮৩ সালে প্রোনোমিনালাইজেশন ইন বেঙ্গলি নামে বাংলা একাডেমি থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশে খুব কম লেখকের বাণীই কোটেশন হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। এর মধ্যে হুমায়ুন আজাদের দুই শতাধিক বাণী বিভিন্ন সময় আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করি। তাঁর উল্লেখযোগ্য বাণীগুলো-
আগে কারো সাথে পরিচয় হ’লে জানতে ইচ্ছে হতো সে কী পাস? এখন কারো সাথে দেখা হ’লে জানতে ইচ্ছে হয় সে কী ফেল?
শ্রদ্ধা হচ্ছে শক্তিমান কারো সাহায্যে স্বার্থোদ্ধারের বিনিময়ে পরিশোধিত পারিশ্রমিক। আজকাল আমার সাথে কেউ একমত হ'লে নিজের সম্বন্ধে গভীর সন্দেহ জাগে। মনে হয় আমি সম্ভবত সত্যভ্রষ্ট হয়েছি বা নিম্নমাঝারি হয়ে গেছি।
অনেকেই আজকাল জনপ্রিয়তার পথে নেমে যাচ্ছে। উন্নতি হচ্ছে ওপরের দিকে পতন। অনেকেরই আজকাল ওপরের দিকে পতন ঘটছে।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭০টির বেশি। হুমায়ুন আজাদের ১০টি কাব্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ২২টি সমালোচনা গ্রন্থ, আটটি কিশোরসাহিত্য, সাতটি ভাষাবিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থ তাঁর জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে নারীবাদী গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘নারী’ প্রকাশ করে গোটা দেশে সাড়া তুলেন। বইটি ১৯৯৫ থেকে ২০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ছিল। এ গ্রন্থ তাঁর বহুল আলোচিত গবেষণামূলক কাজ হিসেবে স্বীকৃত। তিনি ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ২০১২ খ্রিস্টাব্দে সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম এবং ভাষাবিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য মরণোত্তর একুশে পদক লাভ করেন। তাঁর রচিত কিশোরসাহিত্য ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘আব্বুকে মনে পড়ে’ জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে ২০০৩।
তাঁর প্রকাশিত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল’, ‘সব কিছু ভেঙে পড়ে’, ‘মানুষ হিশেবে আমার অপরাধসমূহ’, ‘শুভব্রত’, ‘তার সম্পর্কিত সুসমাচার’, ‘রাজনীতিবিদগণ’, ‘কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ’, ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’, ‘ফালি ফালি ক'রে কাটা চাঁদ’, ‘শ্রাবণের বৃষ্টিতে রক্তজবা’, ‘১০,০০০ এবং আরো ১টি ধর্ষণ’, ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’, ‘একটি খুনের স্বপ্ন’।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘যাদুকরের মৃত্যু’ অন্যতম। গবেষণা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ কাব্য, উপন্যাস ছাড়াও তাঁর কাব্যেও ছিল অনবদ্য লেখনীর ভাব। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলো ‘অলৌকিক ইস্টিমার’, ‘জ্বলো চিতাবাঘ’, ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’, ‘যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল’, ‘আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে’, ‘হুমায়ুন আজাদের শ্রেষ্ঠ কবিতা’, ‘আধুনিক বাঙলা কবিতা’, ‘কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু’, ‘পেরোনোর কিছু নেই’।
কিশোরসাহিত্যের মধ্যে রয়েছে ‘লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী’, ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’, ‘কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী’, ‘আব্বুকে মনে পড়ে’, ‘বুকপকেটে জোনাকিপোকা’, ‘আমাদের শহরে একদল দেবদূত’, ‘অন্ধকারে গন্ধরাজ’, ‘আওয়ার বিউটিফুল বাংলাদেশ’ ছাড়াও তাঁর সমালোচনাগ্রন্থ, ভাষাবিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয়ে প্রচুর সাহিত্য ও গবেষণাকর্ম রয়েছে।
একটি পার্টি থেকে আসার পর ২০০৪ সালের ১২ আগস্ট ফ্ল্যাটের নিজ কক্ষে তাঁকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
লেখক : ছড়াকার ও সাংবাদিক