অভিমত
রাজন থেকে বনানী, ফেসবুকের শক্তি
সিলেটের শিশু রাজনকে পিটিয়ে হত্যা, খুলনার শিশু রাকিবকে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা, সিলেটের কলেজছাত্রী খাদিজা আক্তারকে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টা—এ রকম চাঞ্চল্যকর ঘটনাগুলোর বিচার দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন হওয়ার মূল কৃতিত্ব অবশ্যই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, আরো পরিষ্কার করে বললে ফেসবুকের। নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে কান ধরে ওঠবস করানোর ছবিও যদি ফেসবুকে ভাইরাল না হতো, তাহলে এত দিনে নিশ্চয়ই শ্যামল কান্তিকে ধর্ম অবমাননার দায়ে জেলখানায় থাকতে হতো; অথবা তাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হতো।
এসব ঘটনার ভিডিও প্রথমে ফেসবুকেই ভাইরাল হয়েছে এবং এরপর এগুলো পিক করেছে মূলধারার গণমাধ্যম। অর্থাৎ সোশ্যাল মিডিয়া এখানে মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার সহায়ক বা সংবাদ উৎস হিসেবে কাজ করেছে। যার ধারাবাহিকতায় আমরা দেখছি পুলিশ দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করেছে বা করতে বাধ্য হয়েছে রাজধানীর বনানীর একটি হোটেলে দুই তরুণীকে ধর্ষণ মামলার দুই আসামিকে। এই ঘটনায় পুলিশ প্রথমে মামলা নিতেই গড়িমসি করেছিল। কিন্তু ফেসবুকে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া এবং গণমাধ্যমের অব্যাহত চাপে বলা যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেকটা বাধ্য হয়েই প্রভাবশালী পরিবারের ওই দুই সন্তানকে সিলেট থেকে গ্রেপ্তার করে। বাকি আসামিরাও দ্রুত গ্রেপ্তার হবে বলে আশা করা যায়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কী করে একটি ঘটনাকে মূলধারার গণমাধ্যমের লিড স্টোরিতে পরিণত করতে পারে, তার সবশেষ উদাহরণ বনানীর এই ঘটনা। অস্বীকার করার উপায় নেই, শুরুর দিকে দুয়েকটি পত্রিকা বাদে মূলধারার কোনো গণমাধ্যমই বনানীর ওই ঘটনা নিয়ে সেভাবে রিপোর্ট করেনি। কিন্তু ফেসবুকে যখন বিষয়টা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়, তখন মেইনস্ট্রিম মিডিয়া বাধ্য হয়েছে এটাকে পিক করতে। যে কারণে বলা হয়, এখন এই তথ্যপ্রযুক্তি এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে কোনো খবরই আর ব্ল্যাকআউট করা বা চেপে যাওয়ার সুযোগ নেই। যদি কোনো গণমাধ্যম চেপে যায়, তাহলে তার দর্শক, পাঠক ও শ্রোতাপ্রিয়তা কমে যায়। তার বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস পায়।
ফেসবুক কী করে একটি ঘটনাকে অন্যতম আলোচিত ঘটনায় পরিণত করতে পারে , তা টের পাওয়া যায় বনানীর ওই ঘটনার অন্যতম আসামি সাফাত আহমেদের বাবা আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের কথায়। একজন সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনারা টাকা দিয়ে বিষয়টা ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলেন—এ রকম একটা অভিযোগ আছে। জবাবে দিলদার বলেন, ভাইরে, এটা এখন রাষ্ট্রীয় ব্যাপার। রাষ্ট্রীয় ব্যাপার টাকা দিয়ে ধামাচাপা দেওয়া যায় না।
তবে এটা ঠিক, মোটা অঙ্কের পয়সা খেয়ে মামলা না নেওয়া, মিথ্যা মামলায় আসামি করা, অসত্য প্রতিবেদন দেওয়া, প্রতিবেদন দিতে গড়িমসি করা ইত্যাদি নানাবিধ অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে আছে। কিন্তু পুলিশ বাহিনীর সবাই যে খারাপ তাও নয়। নয় বলেই আসামিরা গ্রেপ্তার হয়েছে এবং ডিএমপির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, তাঁরা এমনভাবে ঘটনাটির তদন্ত করছেন যে, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। আমরা বরং সেই মাইলফলক দেখার প্রত্যাশা করছি।
আবারও ফেসবুক প্রসঙ্গ। আমরা স্মরণ করতে পারি, দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণজমায়েত, যেখানে রাজনৈতিক দল, ধর্ম, বয়স, পেশা নির্বিশেষে সব মানুষ একত্রিত হয়েছিলেন শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে, সেটিরও অনুঘটক এই ফেসবুক বা বিকল্প গণমাধ্যম। অনেক সময়ই মূলধারার গণমাধ্যমের অনেক আগেই মানুষ ফেসবুকের মাধ্যমে খবর জেনে যাচ্ছে। অনেক সময় অনেক ভুল ও ভুয়া খবরও রটে যায়। কারণ স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট সহজলভ্য হতে থাকায় এখন যখন যেখানে যা কিছুই ঘটুক না কেন, মানুষ তৎক্ষণাৎ তা ফেসবুকে আপলোড করে দেয়। কখনো স্ট্যাটাস, কখনো ছবি, কখনো ভিডিও। অনেক সময়ই তার সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন থাকে।
আসা যাক ব্লগিং প্রসঙ্গে। ব্লগে অনেকেই সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী লেখালেখি করেন। এখানে অনেক তথ্যমূলক লেখা যেমন থাকে, তেমনি অনেক লেখা সমাজের মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে, কখনো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়, আবার কখনো সাম্প্রদায়িক উসকানি দেয়—এমন অভিযোগও মেলে।
ফেসবুক ও ব্লগে যেহেতু সরাসরি কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেই, যেহেতু এখানে সরকার সরকারি নাক গলায় না, যেহেতু এখানে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগ কম, তাই নাগরিকরা নিজের প্রতিক্রিয়া কোনোরকম সম্পাদনা ছাড়াই এখানে প্রকাশের সুযোগ পায়। যে কারণে অনেক সত্য বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভ্রান্তিকর, মিথ্যা ও ভুল তথ্যও হামেশা প্রকাশিত হয়। এখানেই মূলধারার গণমাধ্যমের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা বিকল্প গণমাধ্যমের তফাৎ। কিন্তু তারপরও এখন অনেক বড় বড় ঘটনারই অনুঘটক এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম—এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
বলা হয়ে থাকে, সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে মুক্তচিন্তা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা অনেক সহজতর হয়েছে। কিন্তু মুক্তচিন্তা আর মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে অন্যের ব্যক্তিগত জানালায় টোকা দেওয়া , অন্যকে হেয় করা, কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া, সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়া—ইত্যাদিও ঘটেছে। ফলে মূলধারার গণমাধ্যমের সঙ্গে এর প্রধান পার্থক্য রচিত হচ্ছে দায়বদ্ধতায়, সম্পাদনায়।
মূলধারার গণমাধ্যমে একজন সাংবাদিক যা ইচ্ছে তাই লেখার বা বলার সুযোগ পান না। তাকে একটা নির্দিষ্ট গেট পেরিয়ে অর্থাৎ সম্পাদনার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। একটি লেখা একাধিক হাত ঘুরে পাঠক ও দর্শক-শ্রোতার কাছে যায়। ফলে সেখানে যদি কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া বা সাম্প্রদায়িক উসকানি তৈরির মতো কিছু থাকে, সেটি বাদ দেওয়ার সুযোগ থাকে; সোশ্যাল মিডিয়া বা বিকল্প গণমাধ্যমে এর সুযোগ নেই।
তারপরও এই বিকল্প গণমাধ্যমই জনপ্রিয় হচ্ছে এবং কখনো কখনো এটি মূলধারার গণমাধ্যমকে চ্যালেঞ্জ করছে এবং এটি এ কারণে সম্ভব হচ্ছে যে, মূলধারার গণমাধ্যম সমাজের সব মানুষের কথা বলে না। সব জায়গায় পৌঁছে না। অনেক ধরনের সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়।
তবে আমরা যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ফেসবুকের শক্তির কথা বলছি, সেখানে আরো অনেক হতাশা আছে। ধরা যাক কুমিল্লার কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর কথা। গত বছরের ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাসের ভেতরের একটি ঝোপ থেকে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তাঁকে ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয়েছে বলে সবাই বিশ্বাস করলেও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বলছে ভিন্ন কথা। ফলে এটি নিয়েও বিতর্ক আছে। এ ঘটনায় তনুর বাবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী ইয়ার হোসেন থানায় মামলা করেন। কিন্তু এত দিনেও খুনিদের শনাক্ত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ ঘটনা নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং গণমাধ্যমে তোলপাড় হলেও, সারা দেশে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হলেও কোনো এক অদৃশ্য শক্তির ইশারায় অপরাধীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার শক্তির কথা বললেও, বোধ হয় সেই অদৃশ্য শক্তি সামাজিক যোগাযাগমাধ্যম এমনকি গণমাধ্যমের চেয়েও বেশি শক্তিশালী।
লেখক : সাংবাদিক