তিলে তিলে তাঁর ক্ষয়?
১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস, গণ-অভ্যুত্থানের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে আইয়ুব সরকার। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিয়ে রাজবন্দিদের মুক্তি দিয়েছে। সারা দেশ উত্তাল, মানুষের মধ্যে বিজয়ের আনন্দ। ২৪ ফেব্রুয়ারি রিকশায় করে বাসায় ফিরছিলেন কবি ও গীতিকার ফজল-এ-খোদা। কিছুটা আনমনা ছিলেন, পাকিস্তানের অন্যায়-জুলুমের প্রতিবাদ করতে গিয়ে শহীদ অগণিত মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি গান লিখলে কেমন হয়, ভাবছিলেন তিনি। হঠাৎ একটি লাইন পেয়েও গেলেন, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম, সকল শহীদ স্মরণে।’ ঘোরগ্রস্ত হয়ে গেলেন, সারা রাস্তা মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকল, সালাম সালাম...।
রাতে বাসায় ফিরে পুরো গানটি লিখে ফেললেন। এরপর পড়লেন বিপাকে। বুঝে উঠতে পারছিলেন না, সুর করাবেন কাকে দিয়ে, গাইবেই বা কে? মাঝে লম্বা সময় চলে গেল। কোনো কিনারাই করতে পারলেন না। তত দিনে সত্তরের নির্বাচন হয়ে গেছে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করছে না ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার। দফায় দফায় আলোচনা চলছে। বিক্ষোভ, মিছিল আর সমাবেশে একাকার চারদিক। শঙ্কা, চাপা উত্তেজনা সবার চোখে-মুখে। দেখতে দেখতে একাত্তরের মার্চ চলে এলো। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’ স্লোগানে রাজপথ কাঁপিয়ে তুলছে জনতা। এরই মধ্যে ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণে মুক্তিসংগ্রামের ঘোষণা দিয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধু।
তারও চারদিন পর ১১ মার্চ ফজল-এ-খোদা দেখা করলেন আবদুল জব্বারের সঙ্গে। ততদিনে বেতার-টেলিভিশন হয়ে প্লেব্যাকেও কণ্ঠ পাকিয়েছেন তিনি। ১৯৬৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘এতটুকু আশা’ চলচ্চিত্রে তাঁর গাওয়া ‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়’ গানটি তখন মানুষের মুখে মুখে। ফজল-এ-খোদা তরুণ জব্বারকে সব খুলে বললেন। টুকরো কাগজে লেখা লাইনগুলো পড়েই গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেল তাঁর। বুঝলেন, তিনি যে পরশ পাথরের সন্ধানে ছিলেন, তা পেয়ে গেছেন।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা ছিল আবদুল জব্বারের। বঙ্গবন্ধু তাঁকে ডাকতেন ‘পাগলা’ নামে। আর তিনি তাঁকে সম্বোধন করতেন ‘বাবা’ বলে। ‘বঙ্গবন্ধু বলেছেন, এখন থেকে বেতার-টিভিতে বাংলায় গান হতে হবে; এমন গান, যে গান শুনে মানুষ শহীদ হওয়ার জন্য জীবন বাজি রাখবে’—ফজল-এ-খোদাকে জানালেন জব্বার।
ক্ষুব্ধ জনতার বারুদ হয়ে থাকা মনে আগুন ধরিয়ে দেবে এই গান—বিশ্বাস ছিল জব্বারের। তাই আর কারো কাছে না গিয়ে নিজেই সুর করে ফেললেন। তারপর একদিন দুজনে গেলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। শুনে বঙ্গবন্ধু রেডিওতে গানটি প্রচারের অনুমতি দিলেন। কিন্তু গোল বাধালেন তৎকালীন রেডিওর সংগীত বিভাগের প্রধান নাজমুল আলম। তাঁর আপত্তি, গানের মধ্যে ‘বাংলাদেশের লাখো বাঙালি, জয়ের নেশায় চলে রক্ত ঢালি’ লাইনটি নিয়ে। বললেন, বাঙালিদের রক্ত ঢালার কথা বলা যাবে না। কারণ, পাকিস্তান আর্মি-পুলিশ তো ‘দুষ্কৃতকারীদের’ শায়েস্তা করছে। তারা সাধারণ মানুষকে তো মারছে না।
এই অদ্ভুত যুক্তি শুনে আবদুল জব্বার ক্ষেপে গেলেন। ফজল-এ-খোদাকে নিয়ে গেলেন ঢাকা বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক আশরাফ-উজ-জামান খানের কাছে। তিনি সব শুনে বললেন, একটি কথার জন্য এই গানের প্রচার বন্ধ করে দেওয়া ঠিক হবে না। গানে ‘রক্ত ঢালি’ জায়গাটি বদলে দিলেই হবে। তারপর গানে ‘চলে রক্ত ঢালি’র বদলে ফজল-এ-খোদা লিখে দিলেন ‘আনে ফুলের ডালি’। ১৪ মার্চ গানটি রেকর্ডের পর সেদিন থেকেই প্রচারিত হতে থাকল। বাকিটা ইতিহাস।
অথচ সেই ইতিহাসের কারিগর আবদুল জব্বারকেই আজ যেন ভুলে গেছি আমরা। মনের আঁধার কালি ঘুচিয়ে ঘরে ঘরে আলোর দেয়ালি জ্বালার ডাক দিয়েছিলেন যিনি, তিনিই আজ আঁধারে ডুবে আছেন। কারণ, আমরা সেই দেয়ালি নিভিয়ে দিয়েছি। তার গাওয়া গানের মতো করেই আজ তার আশার প্রদীপ নিভে যাচ্ছে চোখের জলে। জীবনের পরাজয় দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে এখন হাসপাতালের সফেদ বিছানায় শুয়ে তিলে তিলে ক্ষয়ে যাচ্ছেন তিনি।
একাত্তরে খেয়ে-না খেয়ে, সামান্য অস্ত্র আর অমিত সাহসে ভর করে দিনের পর দিন যুদ্ধ করতে করতে যখন ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসত, তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গানই মুক্তিসেনাদের জাগিয়ে রাখত, স্বপ্ন দেখাত। কানে কানে নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ার মন্ত্র শেখাত। মুক্তির এসব গানই তাঁদের মনে মৃত্যুকে তুচ্ছ করার বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিয়েছিল। বুকজুড়ে দ্রোহের লাভা নিয়ে টগবগ করতে থাকা তরুণদের যুদ্ধ নামের জ্বালামুখের সন্ধান বাতলে দিয়েছিল এসব গান। পঙ্গপালের মতো তরুণরা ছুটে গিয়েছিল যুদ্ধের ময়দানে। আর তাতে তছনছ হয়ে গিয়েছিল ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সব ষড়যন্ত্র।
সেই মুক্তির গানের অন্যতম বিহঙ্গ হয়ে ছিলেন আবদুল জব্বার। মুক্তিযুদ্ধের পরের প্রজন্মের কাছেও গানে গানে মুক্তির বার্তা ছড়িয়েছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, মা, মাটি, মানুষের প্রতি গভীর অনুরাগের বীজ বুনে দিয়েছে তাঁর গান। অথচ জীবন-সায়াহ্নে কষ্টের দরিয়ায় যখন তিনি সাম্পানের নাইয়া খুঁজে পাচ্ছেন না, তখন আমরা তাঁর সহায় হয়ে দাঁড়াতে পারছি না।
কৈশোরে কিংবা তারুণ্যে, বিদেশ-বিভুঁইয়ে কিংবা দেশে বসে, নিঃসঙ্গতায় কিংবা বন্ধুদের আড্ডায় ‘হইয়া আমি দেশান্তরী’ গেয়ে ওঠেনি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া যাবে না। নীল দরিয়ায় বন্দি হয়ে দিবানিশি দারুণ জ্বালায় ধড়ফড় করতে থাকা দেশান্তরী মুখে কাছের মানুষের কাছে ফেরার আকুতির ভাষা জুগিয়েছেন তিনি। একটা প্রজন্ম তাঁর গানে গানেই তারাভরা রাতে প্রিয় মানুষের কথা মনে করেছে। ‘শত্রু তুমি, বন্ধু তুমি, তুমি আমার সাধনা’, ‘এক বুক জ্বালা নিয়ে বন্ধু তুমি, কেন একা বয়ে বেড়াও’, ‘ওগো তন্বীতনুলতা’, ‘বহ্নি আঁখি’, ‘বিদায় দাও গো বন্ধু তোমরা’, ‘আমি তো বন্ধু মাতাল নই’, ‘শিকল ছিঁড়িতে না পারে, খাঁচা ভাঙিতে না পারে, পাখি ছটফটায়া মরে’, ‘পিচঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছি’, ‘তোমাদের জলসাঘরে আমি যে গাইতে এলাম’সহ আরো কত কত গান! তাঁর গানের প্রভাব আমরা অস্বীকার করব কীভাবে? বিবিসি বাংলা ২০০৬ সালে শ্রোতাদের মনোনীত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০ বাংলা গানের যে তালিকা করেছিল, সেখানে আবদুল জব্বারের গাওয়া গানই ছিল তিনটি (‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ ও ‘তুমি কি দেখেছ কভু’)। কেবল মুক্তিযুদ্ধ কেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও নানা ক্রান্তিকালে মানুষকে ভরসা জুগিয়েছে মুক্তির গান। আজও যেমন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে পথ দেখায়।
আবদুল জব্বারই গেয়েছেন, ‘কী গান শোনাব ওগো বন্ধু, মানুষের নেই মানবতা’। মানবতা যে আজ নির্বাসে, তার প্রমাণ মেলে তাঁর দিকে তাকালেই। শরীরে কঠিন ব্যামো নিয়ে সহমর্মিতার আশায় প্রহর গুনছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে। আমরা কি তাঁর খবর রেখেছি?
কণ্ঠ তাঁকে দুই হাত ভরে দিয়েছে, কিন্তু ধরে রাখতে পারেননি। ব্যক্তিগত জীবনও ছিল টালমাটাল। রংভরা এই শহরের গোলকধাঁধার চক্করে পড়ে পথ হারিয়েছেন।
একাত্তরে যে সোনালি স্বপ্ন দেখেছিলেন, বুকে হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে ঘুরে ঘুরে গানে গানে যে স্বপ্ন ফেরি করেছেন, তা আজ ফিকে হয়ে গেছে। পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেননি। তাই পরিবর্তিত এই লাল-নীল সমাজ সাদা-কালো যুগের স্বপ্নের ফেরিওয়ালাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। এ সমাজের কালজয়ী শিল্পীর প্রয়োজন নেই, তাঁদের কেবল চাই ‘দুই দিনের’ শিল্পী।
আজ শেষ বেলায় তাই আবদুল জব্বারকে আকুতি জানাতে হচ্ছে, ‘আমি আরো কয়েকটা দিন বাঁচতে চাই।’ একবুক অভিমান নিয়ে বলছেন, ‘যখন লাইফ সাপোর্টে থাকব, তখন হয়তো অনেকেই দেখতে যাবেন। মারা গেলে শহীদ মিনারে নিয়ে ফুল দেবেন, দাফন করার সময় রাষ্ট্রীয় স্যালুট দেবেন। এগুলো আমার কিছু দরকার নেই। আমি আরো কিছুদিন বাঁচতে চাই।’
চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে আবদুল জব্বার জানিয়েছেন, ক্রনিক কিডনি ডিজিস (সিকেডি) স্পেস ফোরে ভুগছেন। তাঁর যকৃতে সমস্যা রয়েছে। হৃদযন্ত্রের ভাল্বও শোচনীয়। কোমরে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। তাঁর চিকিৎসা করাতে ৮০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা প্রয়োজন। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ২০ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন। বিত্তবানদের কেউ কেউও এগিয়ে এসেছেন।
তবু আবদুল জব্বার জানেন না, বাকি অতগুলো টাকার সংস্থান কীভাবে হবে? অথচ যে দেশে বসে তাঁর মতো একজন শিল্পী এক কোটি টাকার জন্য এই হাহাকার করছেন, সেই দেশ থেকে বছরে পাচার হয়ে যায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা। চোখের নিমেষে ব্যাংক থেকে লোপাট হয় যায় হাজার হাজার কোটি টাকা। এক বছরে যে দেশে বিক্রি হয় ৬০টি বিএমডব্লিউ গাড়ি, যার একেটির দামই প্রায় আড়াই কোটি টাকা। তাঁর গানের মতো করেই ‘ছোট ছোট মানুষের অন্ন কেড়ে বড় বড় বাড়িগুলো উঠছে বেড়ে’।
আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধ আর তাঁর চেতনা রক্ষা নিয়ে বক্তৃতাবাজি করতে রাত-দিন ব্যস্ত থাকি, তখন অগোচরে মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত প্রতীকরা তিল তিলে নিঃশেষ হয়ে যায়, আমরা ফিরেও তাকাই না। জাতি হিসেবে আমরা তো বরাবরই অকৃতজ্ঞ। পিতার বুক ঝাঁঝরা করতেও হাত কাঁপেনি এ জাতির।
সেই পোড়া দেশে আবদুল জব্বারদের এভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরাটাই হয়তো নিয়তির বিধান। কারণ, ‘আবার তোরা মানুষ হ’ বলে যে আহ্বান যুদ্ধের পরেই জানানো হয়েছিল, গত ৪৬ বছরেও আমরা তাতে কান দিইনি।
(নোট : আবদুল জব্বার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘সালাম সালাম’ গানটির সুর ঊনসত্তরেই করেছিলেন তিনি। তবে শ্রোতাদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছিল না। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি গাইতে গাইতে ট্রাকে করে ফিরেছেন তাঁরা। গানটির কথা একসময় বঙ্গবন্ধুর কানে পৌঁছে যায়। পরে তিনিই প্রচারের ব্যবস্থা করে দেন। তবে এ লেখায় গানটির ব্যাপারে ফজল-এ-খোদার সাক্ষাৎকারকে ভিত্তি ধরা হয়েছে। জব্বারের চেয়ে তিনি অনেক বিস্তারিতভাবে ইতিহাসটি জানিয়েছেন।)
লেখক : সাংবাদিক