অভিমত
পাহাড়ে বৃষ্টির কান্না এবং দুর্যোগের ‘রোলমডেল’
গ্রীষ্মের দাবদাহে যখন সারা দেশে হাঁসফাঁস, যখন একপশলা বৃষ্টির জন্য মানুষের আকুতি, তখন সেই বৃষ্টিই এই জনপদে নেমে আসে অভিশাপ হয়ে। টানা বর্ষণের স্বাভাবিক পরিণতি পাহাড়ে ধস এবং দেড় শতাধিক মানুষের করুণ মৃত্যু। একজন-দুজন নয়, পরিবারশুদ্ধ মানুষের গণমৃত্যু। শোকে কাতর হবে কে? কে কাঁদবে অঝোরে? কান্নার মানুষও তো মৃত। আর কেউ যদি কাঁদেও, সেই কান্নাও চাপা পড়ে বৃষ্টির কর্কশ আওয়াজে। এখানে বৃষ্টি কোনো রোমান্টিকতার অনুষঙ্গ নয়। এই বৃষ্টিতে ইলিশ-খিচুড়ি কিংবা ধোঁয়াওঠা চায়ের গন্ধ নেই। এই জনপদে টানা বৃষ্টি মানেই আতঙ্ক, মৃত্যুর আমন্ত্রণ। এখানে বৃষ্টি মানে বিচ্ছিন্নতা। বৃষ্টি মানে গৃহহীন মানুষের আশ্রয়কেন্দ্রে মানবেতর জীবন।
কিন্তু যে মানুষগুলোর এমন নির্মম মৃত্যু হলো, তার জন্য কি কেবল এই বৃষ্টিই দায়ী? বৃষ্টি তো হবেই তার নিয়মে। কোনো বছর কম, কোনো বছর বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হঠাৎ করে একটানা বৃষ্টি হবে এবং তাতে পাহাড়ের কোনো কোনো অংশ ধসে যাবে, এই কথা তো পাহাড়ে বসবাসকারীরাও জানে। এবারও ধসের আশঙ্কায় মাইকিং হয়েছিল। মানুষকে সরে যেতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারপরও কেন তারা সরল না? কেন তারা মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণের পথই বেছে নিল? কী এমন অমূল্য সম্পদ তাদের ঘরের ভেতরে ছিল, যার মায়া তারা ছাড়তে পারল না?
পাহাড় ধসে এত মানুষের প্রাণহানির পর এখন বিবিধ সংকটে খাবি খাচ্ছে এই জনপদ, বিশেষত রাঙামাটি। সেখানে ভেঙে পড়েছে যোগাযাগব্যবস্থা, জ্বালানির তীব্র সংকট, খাদ্য সংকট এবং তার আগুন দাম। গণমাধ্যমে যেসব ছবি প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে এখন রাঙামাটিকে মনে হচ্ছে যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদ। ভয়াবহ ধসের পরে নতুন করে ধসের আশঙ্কায় অনেক লোককে নেওয়া হয়েছে নিরাপদ আশ্রয়ে।
যদিও পাহাড়ে এমন মৃত্যুর মহামারী এটিই প্রথম নয়। ২০০৮ সালে বান্দরবান শহরের বালুচরা এলাকায় পাহাড় ধসে ১৩০ জনের প্রাণহানি ঘটে। এর আগে ২০০৭ সালের ১১ জুন টানা বর্ষণে পাহাড় ধসের আরেক মর্মান্তিক ঘটনায় বন্দরনগরী চট্টগ্রামের হাটহাজারী, পাহাড়তলী, বায়েজিদ বোস্তামী, খুলশী এলাকায় নিহত হন ১২৭ জন। ২০০৯ সালের ৬ মে বান্দরবানের গ্যালেঙ্গা এলাকায় প্রায় ৭০০ ফুট উঁচু পাহাড় ধসে সাঙ্গু নদীতে পড়ে যায়। এ দুর্ঘটনায় কোনো প্রাণহানি না ঘটলেও ২৫ ফুট প্রশস্ত সাঙ্গু নদীর অন্তত ১০ ফুটজুড়ে উঁচু বাঁধের সৃষ্টি হয় এবং নৌযান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
তবে ভারি বৃষ্টির কারণে পাহাড়ের কোনো অংশে ধস নামা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও বছরের পর বছর এই পাহাড়ের ওপর যে নির্মম অত্যাচার চালানো হয়, গাছপালা কেটে যেভাবে পাহাড়গুলো ন্যাড়া করে দেওয়া হয়, পাহাড় কেটে যেভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়, তাতে এখন আর এই পাহাড়ধসকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলার সুযোগ নেই; বরং এটি এখন মানুষের কাণ্ডজ্ঞানহীন কর্মের ফল, মানে এটি এখন মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশের পাহাড়গুলোতে কোনো কঠিন শিলা না থাকায় ভারি বৃষ্টি হলেই পানি শুষে মাটি ফুলতে থাকে। মাটিগুলো নরম ও পিচ্ছিল হয়ে যায়। ফলে একসময় মাটি ভেঙে পড়ে। একশ্রেণির ভূমিদস্যু অবৈধভাবে পাহাড় দখল করে বসতবাড়ি তৈরি করে কম টাকায় ভাড়া দেয়। তারা ঘরবাড়ি নির্মাণের সময় সবচেয়ে শক্ত মাটির স্তরও কেটে ফেলে, এমনকি ঘাস ও মাটি ধরে রাখার উপযোগী গাছও কেটে ফেলে। ফলে তীব্র হয় ধসের আশঙ্কা। পয়সাওয়ালা অনেক মানুষ আজকাল সরকারের কাছ থেকে পাহাড় লিজ নিয়ে সেখানে রিসোর্ট গড়ে তোলেন। নানা ফল-ফলাদির চাষ করেন। উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কেটে রাস্তা বানানো হয়। ফলে যখনই ভারি বর্ষণ হয়, প্রকৃতি তখন মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, এসব অপরিকল্পিত উন্নয়নের উল্টো পিঠ।
একটা গালভরা কথা আমরা সব সময়ই সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুনি যে, বাংলাদেশ দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশ্বে রোলমডেল। প্রশ্ন হলো, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় রোলমডেল একটা দেশে কী করে পাহাড় ধসে দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়? আসলে এই বাক্য আংশিক সঠিক। কেননা, বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় রোলমডেল শুধু ঘূর্ণিঝড় আর বন্যাপ্রস্তুতিতে। ঘূর্ণিঝড়ের আগাম সংকেত এবং তারপরে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ায় সবশেষ ঘূর্ণিঝড় মোরার আঘাতে বড় ধরনের প্রাণহানি এড়ানো গেছে। বস্তুত ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডরের পরে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগেই বড় ধরনের প্রাণহানি ঘটেনি। এটা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের একটা বড় সাফল্য। একইভাবে বন্যায় ফসলের ক্ষতি হলেও এখন ওই অর্থে মানুষের মৃত্যু হয় না। কিন্তু এই রোলমডেল যেন কোনো কাজ আসে না পাহাড় ধসে, এই রোলমডেল কাজে আসে না বস্তিতে বড় ধরনের আগুন লাগলে। যদি কখনো মাঝারি মানের ভূমিকম্পও দেশকে নাড়া দেয়, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায়, সেই পরিস্থিতি মোকাবিলার কী প্রস্তুতি আছে? সুতরাং দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা রোলমডেল বলে আত্মতৃপ্তিতে ভুগলেও বাস্তবতা অত্যন্ত করুণ। বিশেষ করে পাহাড়ে যদি বৃক্ষনিধন, অপরিকল্পিত উন্নয়ন আর পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণ বন্ধ না হয়, তাহলে এই রোলমডেলের ব্যর্থতা মাঝেমধ্যেই প্রকাশিত হতে থাকবে।
আমীন আল রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক।