প্রতিক্রিয়া
শিশুরা কি বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকবে না?
দেশের মানুষের মধ্যে নানা অজুহাতে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ কিংবা অনুভূতি খসে পড়বার বিচিত্র কারণ ও রূপরেখা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কারো ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগছে তো আরেকজনের কোটি টাকার মানহানি ঘটে যাচ্ছে। কারো কারো হৃৎকম্পন পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণের ধকল সামাল দিতে প্রশাসন আর বিচার বিভাগেও এখন ঠোকাঠুকি লাগার উপক্রম হচ্ছে।
প্রজাতন্ত্রের একজন নিষ্ঠাবান কর্মী গাজী তারিক সালমন বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা থাকাকালে গেল ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের প্রাক্কালে শিশুদের নিয়ে একটি চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। ঘোষণা অনুযায়ী সেই প্রতিযোগিতা থেকে বাছাই করা বঙ্গবন্ধুর পোর্ট্রেট দিয়ে স্বাধীনতা দিবসের আমন্ত্রণপত্র ছাপেন এবং গণ্যমান্যদের দাওয়াত করেন।
সরকারি এই আমলা তাঁর রুটিন ওয়ার্ক অনুযায়ী একটা যথারীতি কার্ড ছেপে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে শিশুদের মধ্যে দেশের স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চেতনাকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। শিশুরা তাদের মনের মতো করে শিশুতোষ সারল্য ও ভালোবাসা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর মুখচ্ছবি আঁকে। প্রতিযোগিতায় পঞ্চম শ্রেণির এক শিশু শিক্ষার্থীর আঁকা সেরা ছবিই স্থান পায় আমন্ত্রণপত্রে।
যেখানে নতুন প্রজন্ম আগ্রহ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকছে বলে বিষয়টিকে উৎসাহিত করবার কথা, সেখানে উল্টো জুটছে তিরস্কার ও ভর্ৎসনা।
ঘটনার কয়েক মাস পর বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ ওবায়েদুল্লাহ সাজু আগৈলঝাড়ার ইউএনও গাজী তারিক সালমনের বিরুদ্ধে বরিশাল সিএমএম আদালতে পাঁচ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ চেয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। সেই মামলায় ইউএনও সালমনকে কারাগারে প্রেরণ করেন বিজ্ঞ আদালত। আবার একই দিন জামিনও পেয়ে যান সালমান।
এ মামলার বিষয়ে মামলার বাদী সাজু গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এই ছবিটিতে বঙ্গবন্ধুকে বিকৃত করা হয়েছে। এখানে বঙ্গবন্ধুর গালের ওপরে একটি তিল দেওয়া হয়েছে এবং চুলগুলো এলোমেলো করা হয়েছে। শেষ পৃষ্ঠায় বাচ্চার আঁকা ছবি দিয়ে কার্ডটা বানানো হয়েছে বলে আমরা মনে করি, বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে।
যে আওয়ামী লীগ নেতা জানেনই না যে বঙ্গবন্ধুর বাম গালে শনাক্তকরণ চিহ্ন হিসেবে একটি বড় তিল আছে, তার কি কোনো শিশুর আঁকাবুঁকি নিয়ে প্রশ্ন তোলা সাজে? আমরা মনে করি, তাঁর মুখে বঙ্গবন্ধুর নামটা নেওয়াও উচিত নয়। অথচ সেই তিনি কি না এখন পুরো সোশ্যাল মিডিয়া আর গণমাধ্যমের প্রধান খবর।
এ বিষয়টি নিয়ে ওই ধর্মবিষয়ক সম্পাদকের ইউএনওর বিরুদ্ধে করা মানহানির মামলা নিয়ে খোদ আওয়ামী লীগের মধ্যেও রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। ক্ষোভ দেখা দিয়েছে প্রশাসনেও। সরকারি কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন লিখিত বিবৃতির মাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। সালমনকে হাজতবাসের ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়ে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা চেয়েছে তারা। সুশীল সমাজ ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরাও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন বিষয়টি নিয়ে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সাধারণ মানুষও ওই শিশুর আঁকা পোর্ট্রেটটির পক্ষেই তাঁদের রায় দিচ্ছেন।
যদিও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বিবিসি রেডিওর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে মামলার বাদীর পক্ষ নিয়ে বলেছেন, শিশুর ভুল বা আবেগের সুযোগ নিয়ে ইউএনওর দায়িত্বহীন হওয়া সাজে না।
পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীর আঁকা ওই ছবি এখন রীতিমতো ভাইরাল। সবাই দেখছেন, বিচার-বিবেচনা করবার সুযোগও পাচ্ছেন। ওই ছবিতে আদৌ কোনো ভুল আছে কি? বরং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে বঙ্গবন্ধুর স্কেচটি এক দারুণ দ্যোতনা পেয়েছে। একজন শিশুর দেশাত্মবোধের সঙ্গে জাতির পিতার যে অঙ্গীকরণ, তা অতুলনীয়-অদ্বিতীয়। শিশুমনের এমন প্রাগ্রসর ভাবনাকে উৎসাহ না দিয়ে সার্বিকভাবে তাকে দমিয়ে দেওয়ার কাজটাই সাগ্রহে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এমন বাস্তবতায় ওই শিশু এবং সামগ্রিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে যারা আঁকে, তাদের মনে যে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তা কি বড়রা টের পান? শিশুর মনে যদি গেঁথে যায় যে বঙ্গবন্ধুকে আঁকা বিরাট ভুলের কাজ; এমন অবনমিত অনুভূতির নিমজ্জনের দায়টা এখনকার চাটুকার ও অতি উৎসাহী আওয়ামী লীগাররা বইতে পারবেন তো? কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, এই ছবি বঙ্গবন্ধু নিজে দেখলে নিশ্চিতই ওই শিশুকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করে তাকে ভবিষ্যতের পিকাসো হওয়ার আশীর্বাণী দিতেন।
ছবি যে সব সময় রিয়েলিস্টিক হবে না, সেখানে থাকবে বিমূর্ততা, আলোছায়ার যুগলবন্দিতে ছবি হবে কখনো উজ্জ্বল বা ফিকে। রং ও রেখাকে সিম্বলিকভাবে ব্যবহার করেই নতুন ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করবার প্রয়াস পাবেন একজন শিল্পী। এমন বোধবুদ্ধি কোনো প্রান্তিক আওয়ামী লীগ নেতার না থাকলেও চলবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যথার্থ অর্থেই ছবির কদর বুঝতেন।
একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ শেষে এখনকার বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ অস্ত্র জমা দেওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু জানতে পারেন তিনি আর্ট কলেজের ছাত্র। সে সময় শাহাবুদ্দিনকে বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘পারবি না পিকাসোর চেয়ে বড় হতে?’ ছাত্রকালেই স্বপ্নের নায়কের কাছে থেকে এত বড় অনুপ্রেরণা পেয়ে আপ্লুত হন তিনি। সেই অনুপ্রেরণা নিয়ে আট ফুট বাই চার ফুট ক্যানভাসে প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি আঁকেন শাহাবুদ্দিন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিজ হাতে বয়ে নিয়ে যাওয়ার পর শাদা কাপড়ের ঢাকনা খুলতেই চিৎকার করে ওঠেন বঙ্গবন্ধু, ‘এই তাজউদ্দীন, দেখো দেখো কী এঁকেছে! এই তো সোনার ছেলেরা আমার! ওরাই তো একদিন সোনার বাংলা বানাবে! বিদেশ থেকে আসা অতিথিদের সে ছবি দেখিয়েও বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘দেখো, আমার দেশের ছেলেরাও আঁকতে পারে। খালি যুদ্ধ করে না, ছবিও আঁকে।‘
বরিশালের এই লোকদেখানো বঙ্গবন্ধুপ্রেমী কি সেই শিল্পী শাহাবুদ্দিনের আঁকা বঙ্গবন্ধু সিরিজ দেখেছেন? যেখানে সামান্য বিমূর্ত প্রতীকী অবয়ব ছাড়া বঙ্গবন্ধুকে চেনার কোনো উপায় নেই। অমন ছবি দেখবার পর মানহানির টাকার অঙ্কটা গণনযন্ত্রের হিসাবে কুলোবে তো? অথবা দেশের প্রতিথযশা চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার তো কয়েকটা রেখার টানেই বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবি ক্যানভাসে দৃশ্যমান করতে পারেন কিংবা শিশির ভট্টাচার্য্য যদি নিজস্ব ঢঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে আঁকেন, সেগুলো দেখে অনুধাবন করবার আগেই তো আপনাদের হৃদযন্ত্র বিকল হওয়ার কথা!
বরেণ্য শিল্পী হয়ে উঠতে বঙ্গবন্ধু শাহাবুদ্দিনকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন আর আপনারা কী করছেন? অনুভূতি নষ্ট হওয়ার নাম করে শিশুদের কল্পনাশক্তিকে রুদ্ধ করে দেওয়ার সব বন্দোবস্ত করে চলেছেন। শিশুর আঁকা ছবি বিকৃতির দাবি করে পাঁচ কোটি টাকার মানহানি মামলা করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তির দাম মাত্র পাঁচ কোটি টাকা? আর সেই টাকার মূল্যে কিনা পণ্য হিসেবে ধার্য করা হলো একটি শিশুর সরল মনের ঐশ্বর্যে আঁকা অনিন্দ্য চিত্রকলাকে। এ এক অবিশ্বাস্য ও অভাবনীয় ঘটনাই ঘটতে দেখল বাংলাদেশ!
শিশুদের মধ্যে চারুকলা চর্চার উদ্দেশ্যই হলো তাঁদের নৈতিক, মানবিক ও নান্দনিক বিকাশ ঘটানো। তাঁদের মধ্যে দেশাত্মবোধ, সৃজনশীলতা জাগানো এবং উন্নত জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ করা। সেখানে একজন কোমলমতি শিশুর আঁকা ছবি নিয়ে রাষ্ট্রীয় তুলকালাম স্রেফ বোধবুদ্ধির অপচয় ছাড়া কিছু নয়! দেশে তো অনেক দাগি অপরাধীও বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের তো আদালতের বারান্দায় পাঠানোর ব্যাপারে কারো মাথা ব্যথা দেখি না! অথচ নিষ্কলুষ একটা কার্ড ছাপানোকে কেন্দ্র করে সরকারি কর্মচারীকে হাতকড়া পরিয়ে জেলের চৌদ্দ শিক দেখানো হলো।
আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি অতলগহ্বরে পতিত হওয়ার আগে তাদের তলিয়ে দেখা উচিত, আগৈলঝাড়ায় দায়িত্ব পালনকালে সালমন নামের এই ইউএনওকে দিয়ে কোনো অন্যায় আবদার মেটাতে না পারায় লোভী ও লুটেরা কোনো ক্ষমতাসীন রাজনীতিকের শিষ্যসাবুদরা মামলার নামে একহাত নিতে চাইছে না তো? আমরা বিজ্ঞ আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। অবিলম্বে বাদী কর্তৃক বাজে উদাহরণ সৃষ্টি করা ওই মামলা তুলে নিয়ে ইউএনও তারিক সালমন অয়নের নির্বিঘ্নে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের সুযোগ নিশ্চিত করা হোক। ভাবমূর্তি বিনষ্টির ভয় ভুলে বাংলার শিশু সন্তানরা মন খোলে ছবি আঁকুক।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।