প্রতিক্রিয়া
ক্রসফায়ার ও সাংসদ এনামুরের বক্তব্য
আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে বাংলাদেশে প্রায়ই ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারে’ কুখ্যাত অপরাধী, সন্দেহভাজন বা চিহ্নিত অপরাধী মারা যায়। ২০০২ সালে বাংলাদেশে সন্ত্রাস দমনের জন্য স্বল্পমেয়াদি অপারেশন ক্লিনহার্ট চালু হয়েছিল। ২০০৪ সালে পুরোদমে অপারেশন ক্লিনহার্ট পরিচালনাকালে ‘ক্রসফায়ার’ ব্যবহার শুরু করা হয়। এর পর পরই আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের শুরু হয়।
ঐ বছরই বাংলাদেশ র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব নামক ‘এলিট ফোর্স’-এর যাত্রা শুরু হয়। সেই সময় চাঞ্চল্যকর জঙ্গি ও বেশকিছু দাগি অপরাধীদের কুপোকাত করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় র্যাব। কিন্তু সাম্প্রতিককালে এই বাহিনীর বিরুদ্ধে ক্রসফায়ার, অপহরণ বা গুমের অভিযোগ ওঠায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছেন তারা। এখন এই বাহিনীকেই তুলে দেওয়ার দাবি তুলছেন অনেকে।
এমন একটা অবস্থায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এক সংসদ সদস্য লিস্ট ধরে ক্রসফায়ার বা বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করলে সর্বত্র তোলপাড় শুরু হয়। যদিও চাপের মুখে তিনি তার বক্তব্য থেকে সরে এসে পরে লজ্জিত হয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন।
ঢাকা-১৯ আসনের (সাভার) সাংসদ এনামুর রহমান নির্বাচনী এলাকার সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্প্রতি একটি পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘সাভারে অনেক ক্যাডার আর মাস্তান ছিল। এখন সব পানি হয়ে গেছে। কারো টুঁ শব্দ করার সাহস নেই। পাঁচজনকে ক্রসফায়ারে দিয়েছি আরো ১৪ জনের লিস্ট করেছি। সব ঠান্ডা। লিস্ট করার পর যে দু-একজন ছিল, তারা আমার পা ধরে বলেছে, আমাকে জানে মাইরেন না আমরা ভালো হয়ে যাব।’
একজন সংসদ সদস্যের এমন বক্তব্যে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন সাভার এলাকার বিরোধী দলের নেতাকর্মীসহ অনেকেই। বিশেষ করে যাদের পরিবারের কারো নামে মামলা আছে তারা দিশেহারা হয়ে পড়েন এমপির ক্রসফায়ারের তালিকায় তাঁদের কারো নাম আছে কি না এই ভাবনায়। সাভার এলাকার অনেকেই আওয়ামী লীগের স্থানীয় বিভিন্নসারির নেতা ও গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে সাংসদ কথিত ও তালিকার খোঁজখবরও জানতে চান।
এ বক্তব্যের পর ওই সংসদ সদস্য নিজের দলের ভিতরে ও বাইরে ব্যাপক চাপের মুখে পড়েন। কারণ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়গুলো সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফে কখনোই স্বীকার্য হিসেবে দেখা যায়নি। সেখানে জাতীয় সংসদের একজন আইন প্রণেতার মতো দায়িত্বশীল ব্যক্তি যখন পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে জানান দেন যে, তাঁর এলাকায় ক্রসফায়ার ব্যবহার করে সন্ত্রাস দমন করা হচ্ছে; তখন জনমনে তা বিশ্বাস্যরূপেই গৃহীত হয়। বিশেষ করে বিএনপির নেতাকর্মীরা খানিকটা বেশিই আতঙ্কিত বোধ করেন এজন্য যে, তারাই বারবার অভিযোগ করে আসছেন তাঁদের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী ইতিমধ্যে নিখোঁজ রয়েছেন। তাঁদের আরো দাবি, সেসব নেতাকর্মীকে ইতিমধ্যে গুম করে ফেলা হয়েছে।
সংসদ সদস্য নিজ মুখে বলেন যে, গুন্ডা মাস্তানরা তার পা ধরে কাঁদছেন এই বলে যে, আমাদেরকে জানে মাইরেন না। বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে এমন সরব আলোচনা এর আগে কেউ করেছেন বলে মনে হয় না। একজন সাংসদ মাস্তানদের মেরে ফেলার ভয় দেখাতে পারেন কি? দণ্ডবিধির কোনো ধারায় কি উল্লেখ আছে গুণ্ডামির শাস্তি ক্রসফায়ারে মৃত্যু? তিনি যদি দেশের প্রচলিত আইন সম্পর্কে এতটাই অজ্ঞ হবেন, তবে তিনি সংসদে জনকল্যাণে আইন প্রণয়ন করবার কোনো যোগ্যতা রাখেন কি?
সাংসদ এনামুর এমন একটা সময়ে ‘ক্রসফায়ারে’র কথা স্বীকার করলেন যখন র্যাবের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে দেশ-বিদেশে কঠোর সমালোচনা হচ্ছে। মাঝে মাঝেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী পরিচয় দিয়ে লোকজনদের ধরে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠছে। আমেরিকা বা ব্রিটেনের মতো কোনো কোনো দেশ যারা আমাদের র্যাবকে প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করত, যন্ত্রপ্রকৌশল দিত তারা সেই সহায়তা স্থগিত পর্যন্ত করেছে।
সম্প্রতি সুইডিশ রেডিও বাংলাদেশে ক্রসফায়ারে হত্যা, গুম ও নির্যাতন বিষয়ে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে র্যাবের এক উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা সাড়ে ৮মিনিট ধরে র্যাবের কর্মকাণ্ড বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। প্রতিবেদনটি দুই ঘণ্টার আলাপচারিতার সারসংক্ষেপ। ওই কর্মকর্তার নাম প্রকাশ না করে তাঁর বক্তব্য গোপনে ধারণ করা হয়েছে বলে দাবি করেছে রেডিওটি৷
সুইডিশ রেডিওর দাবি মতে, উচ্চ পর্যায়ের ওই কর্মকর্তাকে বলতে শোনা যায় যে, গুমকে বাস্তবায়ন করতে তিন ধরনের কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়৷ সেগুলো হলো – টার্গেটকে ধরা, তাকে হত্যা করা এবং মরদেহটি উধাও করে দেওয়া৷
ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, প্রতিদিন লোকজন গুম হচ্ছে৷ নির্দোষ ব্যক্তিরাও গুম হচ্ছে, এভাবে যে কেউই হত্যার শিকার হতে পারে৷ রাজনৈতিক বিরোধীদের থেকে পরিত্রাণ পেতে এটি একটি উপায় হতে পারে৷ এটি জনসংখ্যা বৃদ্ধি কমানোর একটি উপায় হয়ে থাকতে পারে বলেও মত দেন তিনি। অবশ্য এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর র্যাবের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়- এটি ভিত্তিহীন ও ভুয়া। জনগণও চায় র্যাব এই প্রতিবেদনকে ভুল প্রমাণ করুক, তাহলে জনমনে শান্তি নেমে আসবে।
তবে আমাদের দেশের ক্রসফায়ার, অপহরণ, গুম নিয়ে যখন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় খবর হয় তখন যেকোনো মানুষের জন্যই তা উদ্বেগের। তার ওপর একজন সাংসদ যখন নিজ মুখে লিস্ট ধরে ধরে ক্রসফায়ারে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন তা হয় রীতিমতো ভয়ের।
র্যাব কী করতে পারে, এর বড় উদাহরণ সাম্প্রতিককালে র্যাবের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ সহায়তা ও সমর্থনে নারায়ণগঞ্জের ক্যাডার নূর হোসেন কর্তৃক সাত খুন!
এমন পরিস্থিতিতে সাংসদ এনামুরের মুখের কথাকে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। সরকারের নিরপেক্ষ এজেন্সি দিয়ে বিষয়টি তদন্ত করবার দাবি রাখে। তিনি যেহেতু কথাগুলো বলে দিয়েছেন এবং তা গণমাধ্যম থেকে মুছে ফেলবার আর উপায় নেই; সরকারের উচিত হবে আন্তরিকতা নিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখা। মানবাধিকার কমিশনও বিষয়টি নিয়ে স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারে।
ভাবমূর্তির রক্ষার দোহাই দিয়ে এখন আর এই জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে পাশ কাটানোর কোনো সুযোগ নেই। একজন সাংসদকে তিরস্কার বা বকাঝকার মাধ্যমেই জনগুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়ে যায় না। মানুষের আতঙ্ক, উদ্বেগ ও ভয় কমাতে হলে তাদের সমালোচনা ও দাবিগুলোকে আমলে নিয়ে সরকারের উচিত ক্রসফায়ার, গুম ও অপহরণ বিষয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করা। দেশে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে চাইলে ‘বিচার বহির্ভূত’ হত্যাকাণ্ডের রাশ টেনে ধরা এখনই জরুরি। গভীর ভাবনাটার শুরু করা যাক এই মুহূর্ত থেকেই, এনামুরের মতো সত্য স্বীকার করবেন নাকি লজ্জিত ও দুঃখিত বলে সবকিছু না দেখার ভান করবেন।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন