দৃষ্টিপাত
আইএস সংশ্লিষ্ট মার্কিন সেনা ও সংশয়
২০০৭ সালে শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইসহ জেএমবির শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির পরে ধরে নেওয়া হয়েছিল, দেশে জঙ্গি তৎপরতার আপাতত অবসান হলো। কিন্তু দেখা গেল এরপর নব্য জেএমবি, আনসার আল ইসলাম, আনসারুল্লা বাংলা টিম অথবা আল-কায়েদার ভারতীয় শাখা––এরকম বিবিধ নামে জঙ্গিরা তৎপর এবং গা শিউরে ওঠার মতো কর্মকাণ্ড তারা চালাচ্ছে; যার সবশেষ উদাহরণ ২০১৬ সালের পয়লা জুলাই রাজধানী ঢাকার খোদ কূটনীতিকপাড়ায় হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা।
গত ১০ জুলাই ইরাকের প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল এবাদি দেশটির অন্যতম বড় শহর মসুলে জঙ্গি সংগঠন আইএসের বিরুদ্ধে যেদিন বিজয়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন, সেদিনই যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইতে আইএস সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে এক মার্কিন সেনাকে গ্রেপ্তারের খবর জানায় এফবিআই।
যে কারণেই হোক, এই খবরটা বাংলাদেশের গণমাধ্যমে খুব বেশি গুরুত্ব পায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই থেকে গ্রেপ্তার হওয়া ইকাইকা ক্যাং নামে ৩৪ বছর বয়সী ওই মার্কিন সেনা হনুলুলুর স্কফিল্ড ব্যারাকে সংযুক্ত ছিলেন। এর আগে তিনি ইরাক, আফগানিস্তান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় দায়িত্ব পালন করেছেন এবং সামরিক বাহিনীর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। এর মধ্যে মানবাধিকার রক্ষায় ভূমিকা রাখায় হিউম্যানিটেরিয়ান সার্ভিস মেডেলও পেয়েছেন ক্যাং। তার বাবা ক্লিফোর্ডও একজন সাবেক মার্কিন সেনা কর্মকর্তা যিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ক্যাং সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আলোচিত নাইন ইলেভেন হামলার পর।
গ্রেপ্তারের দুদিন পর এফবিআই ২৪ পৃষ্ঠার যে অভিযোগপত্র দেয় সেখানে ক্যাংয়ের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে পৃষ্ঠাপোষকতার অভিযোগ আনা হয়। যদিও তিনি কী কারণে বা কীভাবে আইএসের প্রতি অনুরক্ত হলেন বা সম্পৃক্ত হলেন তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে ধারণা করা হচ্ছে, ইরাক ও আফগানিস্তানে অভিযানের সময় তিনি আইএসের প্রতি আকৃষ্ট বা মগজধোলাইয়ের শিকার হতে পারেন। ক্যাংয়ের আইনজীবী বার্নি ব্যারভার জানান, তিনি চাকরিবিষয়ক কিছু মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। সরকার বিষয়টা জানত; কিন্তু আমলে নেয়নি।
তবে কারণ যাই হোক; ক্যাংয়ের মতো মানবাধিকার রক্ষায় পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন সেনা সদস্যর সঙ্গে যখন বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জঙ্গি বলে পরিচিত এবং বিবেচিত আইএসের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়, তখন সন্ত্রাস ও জঙ্গিবিরোধী যুদ্ধ এবং ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য আরো অনেক বিপদ যে অপেক্ষা করছে, তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করলে সেটি কাকের মতো নিজের চোখ বুজে অন্যের চোখ ফাঁকি দেওয়ার মতোই বোকামি হবে।
জঙ্গিবাদের ভবিষ্যৎ
ইরাকি প্রধানমন্ত্রী যেদিন মসুল জয়ের উৎসব করেন, সেদিন যুক্তরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ সামরিক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল স্টিফেন টাউনসেন্ড বলেছেন, মসুলে এই বিজয়ের পরও আইএসের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই শেষ হয়নি। তিনি মনে করেন, আইএস যাতে নিজেদের নতুন করে সংগঠিত করতে না পারে, সেজন্য ইরাকি সরকারকে দেশটির সংখ্যালঘু সুন্নি মুসলমানদের কাছে যেতে হবে। তারা যেসব রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার, সেগুলো চিহ্নিত করতে হবে। কেননা এসব কারণে সংখ্যাগুরু শিয়াদের সাথে তাদের দূরত্ব ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে।
এই সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তা মনে করেন, আইএসের নতুন উত্থান ঠেকাতে ইরাক সরকারকে ভিন্ন কিছু করতে হবে। সুন্নিদের মধ্যে এমন বিশ্বাস তৈরি করতে হবে যাতে তারা মনে করে যে, বাগদাদের সরকার তাদেরই প্রতিনিধিত্ব করেছ। প্রসঙ্গত, ইরাকে আইএসের মতো জঙ্গি সংগঠন জন্মের পেছনে যেসব কারণ চিহ্নিত করা হয়, তার মধ্যে অন্যতম সংখ্যালঘু সুন্নিদের প্রতি এই বৈষম্য।
কিন্তু প্রশ্ন হলো একজন সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা কেন আইএসের মতো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়লেন? বাংলাদেশেও যখন জঙ্গিবিরোধী অভিযান চলছে, তখন দুজন সাবেক সেনা কর্মকর্তার নাম আমরা জেনেছি, এর মধ্যে একজন মেজর জাহিদুল ইসলাম যিনি রাজধানীর রূপনগরে পুলিশের অভিযানে নিহত হন। এ ছাড়া জঙ্গি কার্যক্রমের পরিকল্পনাকারী হিসেবে সেনাবাহিনীর আরেকজন চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হকের নামও অনেকদিন ধরে শোনা যাচ্ছে।
দুজন সাবেক সেনা কর্মকর্তার এ ধরনের জঙ্গিসংশ্লিষ্টতা সবাইকে বিস্মিত করেছে এবং এটি যথেষ্ট ভয়েরও কারণ। কেন না তাদের যে সামরিক প্রশিক্ষণ রয়েছে, সেগুলোই তারা জঙ্গি তৈরিতে কাজে লাগিয়েছে। তারা কেন বা কীভাবে জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হলো, তার ব্যাখ্যা হয়তো গোয়েন্দাদের কাছে রয়েছে। তবে কোনো বঞ্চনা, বৈষম্য, অবিচার তাদের প্রতিশোধপরায়ণ করে তুলতে পারে বলে ধারণা করা হয়। ফলে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের পাশাপাশি যতক্ষণ না রাষ্ট্র ও সমাজকে বৈষম্যমুক্ত করে গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেই সমাজ ও রাষ্ট্রে চরমপন্থা উদ্ভবের আশঙ্কা থেকেই যাবে। অর্থাৎ একটি মানবিক ও সম্প্রীতির সমাজ বিনির্মাণেই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সবচেয়ে বড় উপায়। সেই লড়াইটা আমরা করছি কি না বা বিশ্ব করছে কি না, নাকি তার বদলে আমরা শুধু ঘৃণার চাষ করছি, নাকি আমরা কেবলই একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সন্ত্রাসী বলতে বলতে তাদের আসলেই সন্ত্রাসের দিকে ঠেলে দিচ্ছি, সেটিই এখন অনেক বড় প্রশ্ন।
ফলে কথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধের ‘প্রধান নেতা’ যুক্তরাষ্ট্রের একজন সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গেও যখন আইএস সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠে, যখন মেজর জাহিদ বা জিয়ার সঙ্গে জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলে, তখন সেগুলোকে স্রেফ বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। ইরাক-আফগানিস্তানে যুদ্ধে অংশ নেওয়া অনেক মার্কিন সেনার আত্মহত্যা বা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ার খবরও বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে এসেছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, ২০০৮ সালে আফগানিস্তান ফেরত ২৬৭ জন মার্কিন সেনা আত্মহত্যা করেন। এর পরের বছর সংখ্যটি দাঁড়ায় ৩০৯ জনে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ১১শ মার্কিন সেনা আত্মহত্যা করেন।
কথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে হাজার হাজার নিরীহ মানুষের প্রাণ গেছে এবং এখনো যাচ্ছে পশ্চিমাদের গুলিতে—যার ভয়াবহতার খুব সামান্যই গণমাধ্যমে আসে। কিন্তু এ রকম নির্মম মৃত্যুর বিভীষিকা সচক্ষে দেখে অনেকের মধ্যেই অনুশোচনা তৈরি হতে পারে; তৈরি হতে পারে প্রতিশোধনপরায়ণতা। ইকাইকা ক্যাংয়ের ক্ষেত্রে ঠিক কী ঘটেছে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
একইভাবে সামরিক বাহিনীর মতো অত্যন্ত সুশৃঙ্খল একটি বাহিনীর ভেতরে থেকে মেজর জিয়া বা জাহিদ কী করে জঙ্গিবাদে দীক্ষিত হলেন, সেটিও ভাবনার বিষয় এবং তাদের মতো আরো কতজন এ রকম দীক্ষা নিয়েছে, তা আমরা জানি না। গত পয়লা জুলাই হলি আর্টিজানের বছরপূর্তির এক অনুষ্ঠানে খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল স্বীকার করেছেন, জঙ্গিদের দুর্বল করা গেলেও এখনো নির্মূল করা যায়নি। পেন্টাগনও এরইমধ্যে সতর্ক করেছে যে, আইএস নির্মূল হয়েছে বলে মনে করা হলেও অন্য নামে এই জঙ্গিরা সংগঠিত হতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেমন হয়েছে, জেএমবির শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির পর নব্য জেএমবি নামে তারা সংগঠিত হয়েছে এবং সেখানে আরো কিছু জঙ্গিগোষ্ঠী একত্রিত হয়েছে।
যদিও বাংলাদেশে আইএস আছে কি নেই, সেই তর্কে সময় গেছে অনেক। বাস্তবতা হলো, এখানে তাদের আদর্শ আছে। সেই আদর্শে দীক্ষিত হয়ে অনেকে সিরিয়ায় গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছে এবং সেই প্রশিক্ষিতদের অনেকে নিহত হলেও আরো কতজন এখনো কী নামে কোন সংগঠনের ব্যানারে সক্রিয়, তা আমাদের জানা নেই। তবে সামাজিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কিংবা অন্য যে কারণেই হোক, কারো জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়াকে জাস্টিফাই করার সুযোগ নেই। ধর্মের নামে হোক আর সন্ত্রাস দমনের নামেই হোক, মানুষ খুন করার লাইসেন্স কাউকে দেওয়া হয়নি। এটা ইরাকে যেমন সত্য, সিরিয়াতেও এবং বাংলাদেশেও। সুতরাং একদিকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হাজার হাজার নিরীহ মানুষের প্রাণ যাবে, একটি রাষ্ট্র ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে আবার অন্যদিকে এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধের বিরুদ্ধে আরেকটি পক্ষ জিহাদের নামে পাল্টা যুদ্ধ চালাবে এবং মানুষ হত্যা করবে—এর কোনোটিই মানবাধিকার সমর্থন করে না।
লেখক : সাংবাদিক।