প্রতিক্রিয়া
লতিফ মোড়লকে মহান পেশার ‘পুরস্কার’ দিলেন আরেক সাংবাদিক
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার সাংবাদিক আবদুল লতিফ মোড়ল। গত ২৫ জুলাই তাঁর ফেসবুকে প্রোফাইল ছবি পরিবর্তন করেছিলেন। ছবির নিচে লেখা আছে, ‘Press সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা।’
এর এক সপ্তাহ না যেতেই হাতে হাতকড়া পরে, কারাবাস করে সেই মহান পেশার ‘পুরস্কার’ পেয়েছেন লতিফ মোড়ল। ‘পুরস্কারের’ কারণ, তিনি একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমের একটি সংবাদ নিজের ফেসবুকের টাইমলাইনে শুধু শেয়ার করেছিলেন। আর এই ‘পুরস্কার’ দিয়েছেন আরেক সাংবাদিক সুব্রত কুমার ফৌজদার। তাঁর বাড়িও ডুমুরিয়ায়।
আবদুল লতিফ মোড়ল খুলনা শহর থেকে প্রকাশিত দৈনিক প্রবাহের ডুমুরিয়া উপজেলা প্রতিনিধি। সেই সঙ্গে তিনি dalitvoice24.com-এর প্রতিনিধি। আর সুব্রত কুমার ফৌজদার যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক স্পন্দন পত্রিকার ডুমুরিয়া উপজেলা প্রতিনিধি।
সাংবাদিক ফৌজদার গত ৩১ জুলাই তাঁর সহযোদ্ধা আবদুল লতিফ মোড়লের বিরুদ্ধে ডুমুরিয়া থানায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করেন। রাতেই পুলিশ লতিফের বাসায় গিয়ে গ্রেপ্তার করে। পরের দিন আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠায়। আজ বুধবার ১০ হাজার টাকা জামিননামায় পুলিশ প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত খুলনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম নুসরাত জাবিন তাঁর অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেন। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে তিনি খুলনা কারাগারে থেকে মুক্তি পান।
বাদী ফৌজদারের এজাহারে কী আছে
এজাহারে বলা হয়েছে, নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী গত ২৯ জুলাই ডুমুরিয়া প্রাণিসম্পদ অফিসে এফসিডিআই প্রকল্পের আওতায় সুফল ভোগীদের মাঝে ছাগল, হাঁস, মুরগি বিতরণ করে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন। পরবর্তী সময়ে প্রাণিসম্পদ অফিসের জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা সুফল ভোগীদের মাঝে ছাগল, হাঁস ও মুরগি বিতরণ করেন। ৩০ জুলাই রাত আনুমানিক সাড়ে ১২টার দিকে সুফলভোগী ডুমুরিয়ার জুলফিকার ঢালীর ছাগলটি মারা গেছে মর্মে ডুমুরিয়া প্রাণিসম্পদ অফিসের কর্মকর্তার মাধ্যমে জানতে পারি। আসামি আবদুল লতিফ মোড়লের ফেসবুক আইডিতে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের দায়িত্বহীনতা ও ‘প্রতিমন্ত্রীর সকালে দেওয়া ছাগল রাতে মৃত্যু’ শিরোনামে মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের ফাইল ফটো আপলোড করে সংবাদ প্রকাশ করে। যা আমি ৩১ জুলাই বেলা আড়াইটার দিকে ডুমুরিয়া বাজারের প্রেসক্লাবের সামনে যাত্রী ছাউনির নিচে বসে উক্ত শিরোনামের সংবাদটি আমার ফেসবুকে দেখে আমি বিস্তারিত জানার জন্য সংবাদটির উপর ক্লিক করি। ক্লিক করে দেখতে পাই, ‘ব্রেকিং নিউজ ডটকমবিডি’ নামের অনলাইনে ছবিসহ সংবাদ প্রকাশ করে। আমি তা দেখে বিস্মিত হই। আসামি ইচ্ছেকৃতভাবে অসৎ উদ্দেশ্যে মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্য ‘প্রতিমন্ত্রীর সকালে দেওয়া ছাগল রাতে মৃত্যু’ শিরোনামের খবরে মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের ফাইল ফটো ছবি আসামির ফেসবুক আইডিতে আপলোড করেছে। আসামি আবদুল লতিফ মোড়ল মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের ফাইল ফটো ছবি সামাজিক ও ব্যক্তিগত মর্যাদা হানি করার লক্ষে ইন্টারনেট/ওয়েবসাইট ও ফেসবুকে সরবরাহ করেছে।’
আসামি আসলে কী করেছিলেন
মামলার বাদী সাংবাদিক সুব্রত কুমার ফৌজদার এজাহারের সঙ্গে ‘প্রতিমন্ত্রীর সকালে দেয়া ছাগল রাতে মৃত্যু’ শিরোনামে সংবাদের প্রিন্টকপি ও ফেসবুকে শেয়ার করা আসামির পোস্টের স্ক্রিনশটের কপি যুক্ত করেন।
এজাহারে থাকা সংবাদের প্রিন্টকপিতে দেখা যায়, সংবাদে প্রতিমন্ত্রীর একটি পুরোনো ছবি দেওয়া আছে। একই ছবি সাংবাদিক আবদুল লতিফ মোড়লের ফেসবুক পেজে শেয়ার করা পোস্টেও আছে। অর্থাৎ তিনি নিজে থেকে প্রতিমন্ত্রীর কোনো ছবি যুক্ত করেননি। তিনি শুধু সংবাদটিই শেয়ার করেছেন। আর শেয়ার করার সময় টাইমলাইনে লিখেছেন, ‘খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের দায়িত্বহীনতা…’।
সাংবাদিক ফৌজদার বিষয়টি না বুঝে, না জেনে ওই পোস্টেই মন্তব্য করেন, ‘মরেছে ছাগল তাতে মন্ত্রী মহোদয়ের ছবি দিয়েছ কেন? তোমার মৃত্যু হলে তুমি কাকে দায়ী করবে।’
এ ছাড়া অন্য আরো বেশ কয়েকজন ভুল বুঝে বেশ কিছু মন্তব্য করেন। অনেকে মনে করেন, নিউজটি তিনিই লিখেছেন।
'শুধু স্যারের সম্মানের জন্য মামলা করেছি'
মামলা করার ব্যাপারে বাদী সুব্রত কুমার ফৌজদারকে এনটিভি থেকে একাধিক বার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি। তবে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি মামলা করার কারণ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার আঘাতের জায়গা হলো মন্ত্রী স্যারের সম্মান। ডুমুরিয়ায় প্রধান অতিথি হিসেবে মন্ত্রী ছাগল বিতরণ করেছেন। কিন্তু ছাগল তো তিনি আনেননি। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এফসিডিআই প্রকল্পের ছাগল বিতরণ করেছে। ছাগল কিনেছে ঠিকাদারের মাধ্যমে। সেই ছাগল একটি মরিছে সত্য। কিন্তু তার কী দোষ।’
সুব্রত ফৌজদার বলেন, ‘ছাগলের মৃত্যু তো বড় বিষয় নয়। ওই স্ট্যাটাসের সঙ্গে মন্ত্রীর একটি ছবি দেওয়া হয়েছে। মৃত ছাগলের ছবি দেওয়া যেত। ছাগলের মালিকের ছবি দেওয়া যেত। কিন্তু মন্ত্রীর ছবি কেন?’
‘২৪-২৫টি ছাগল বিতরণ করা হয়। আর তারমধ্যে একটি ছাগল রাতে মারা যায়। ছাগল মারা গেছে সত্য। কিন্তু ওই ছাগল তো মন্ত্রী দেন নাই। আর মন্ত্রী সব ছাগল বিতরণও করেন নাই। একটি ছাগল দিয়ে তিনি চলে যান। তিনি যে ছাগলটি বিতরণ করেছেন সেটি মারা যায়নি।’
‘মন্ত্রীকে হেয় করার জন্য তার ছবি দিয়ে ছাগল মরার ওই স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছে। এলাকায় মন্ত্রী অনেক উন্নয়ন করেছেন। সেগুলো তারা দেখে না। সব কিছুকেই নেগেটিভ দেখে। আর স্ট্যাটাস দেওয়ার পর ব্রেকিং নিউজও দিয়েছে।’ বলছিলেন সুব্রত কুমার ফৌজদার।
আবদুল লতিফ মোড়লের সঙ্গে কোনো ব্যক্তিগত শত্রুতা আছে কি না জানতে চাইলে সুব্রত ফৌজদার বলেন, ‘প্রেসক্লাবে গ্রুপিং আছে। আমরা দুজন দুই গ্রুপের সদস্য। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো। আমি ব্যক্তিগত কোনো কারণে মামলা করিনি। শুধু স্যারের সম্মানের জন্য মামলা করেছি।’
‘বাদী প্রতিমন্ত্রীর সুবিধাভোগী’
খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ডুমুরিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান গাজী আবদুল হাদি বলেন, ‘প্রতিমন্ত্রীর মানহানি হয়েছে বলে যে মামলা করেছেন সুব্রত ফৌজদার, তিনি প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের খুব কাছের মানুষ এবং সুবিধাভোগী। তিনি দলের কেউ না বা মন্ত্রীর স্বজনও না।’
গাজী আবদুল হাদী বলেন, ‘পুলিশ ও সুব্রতর অতি উৎসাহীর ঘটনায় দল, সরকার ও প্রতিমন্ত্রীর ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। এ জন্য আমরা লজ্জিত।’
সুব্রতর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিবেন কি না প্রশ্ন করলে আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, তিনি দলের কেউ নন। তিনি প্রতিমন্ত্রীর কাছের লোক এবং সুবিধাভোগী।
জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফরিদ আহমেদ জানান, ‘প্রতিমন্ত্রীর সকালে ছাগল বিতরণ, রাতে মৃত্যু’ সংবাদটি প্রতিমন্ত্রীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছিল। বরং মামলা করায় ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে।
৫৭ ধারার অপব্যবহার
সাংবাদিক আবদুল লতিফ মোড়লের জামিন শুনানিতে অংশ নেওয়া আইনজীবী মোশারেফ হোসেন জানান, ফেসবুকে শুধু নিউজের শেয়ার করায় মামলাটি গ্রহণ প্রক্রিয়া সঠিক হয়নি। যারা নিউজটি করেছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়নি, শুধু শেয়ার করায় মামলা হয়েছে। এই ধরনের মামলা হতে পারে না। এই মামলা চলনযোগ্য নয়। তিনি জানান, আবদুল লতিফ মোড়ল জেল থেকে বের হওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
খুলনা আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সুজিত অধিকারী বলেন, এই মামলা করে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার অপব্যবহার করা হয়েছে। সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ ও ফেসবুকের ব্যবহার রোধ করার জন্য এই ধরনের মামলা করা হয়েছে। শুধু নিউজ শেয়ার করার কারণে এই ধরনের মামলা হতে পারে না। ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে মামলা করেছে। এই ধরনের মামলা গ্রহণের বিষয়ে আরো সতর্কতা অবলম্বন প্রয়োজন ছিল বলে জানান তিনি।
মানহানি হয়নি : প্রতিমন্ত্রী
মামলার ব্যাপারে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। গতকাল মঙ্গলবার তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, এ ঘটনায় তাঁর মানহানি হয়েছে বলে তিনি মনে করেন না। তিনি যে ছাগল দিয়েছিলেন সেটা মারা যায়নি।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমি তো সব ছাগল দেই নাই। আমি যেটা দিয়েছি সেটা মারা যায় নাই। মারা গেছে অন্য একটা ছাগল।’
আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন মোড়লের পরিবার
সাংবাদিক আবদুল লতিফ মোড়লের মেয়ে মেহনাজ রেজা মিম্মা গতকাল বিবিসি বাংলাকে টেলিফোনে বলেন, ‘রাত আড়াইটার দিকে আমার আব্বুকে বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ ছিল, আমাদের ডুমুরিয়া থানার ওসি ছিল, আরো ২০ থেকে ৩০ জনের মতো মানুষ এসেছিল। দেয়াল টপকে তারা ঢোকে। তারা আমার রুমেও জোরে জোরে নক করে। আমি জানতে চাই ওনাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। তখন আমাকে বাজে-ভাবে বলা হয় কোথায় নিয়ে যাচ্ছি সেটা আপনার মায়ের কাছ থেকে জেনে নিয়েন।’
মেহনাজ রেজা মিম্মা আজ বুধবার খুলনার আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের জানান, তাঁর বাবার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। তাঁর বাবার কোনো দোষ ছিল না। তিনি শুধু একটি নিউজ শেয়ার করেছিলেন।
মামলা করতে অন্য সাংবাদিকদের চাপ
মামলার বিষয়ে ডুমুরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুকুমার বিশ্বাস আজ এনটিভি অনলাইনকে মুঠোফোনে জানান, ৩১ জুলাই মামলা করার দিন কয়েকজন সাংবাদিক দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত বসে ছিলেন। সে কারণে মামলা নিতে হয়েছে। তবে উপরের কোনো চাপ ছিল না।
ওসি বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মিথ্যা মামলা দায়ের করলে বাদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান আছে। তাই বাদী সুব্রত ফৌজদার যদি ভুল বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে থাকেন তাহলে আইন মতো বাদীর বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গ্রেপ্তারের সময় বাড়াবাড়ির বিষয়টি ওসি অস্বীকার করেছেন।