প্রতিক্রিয়া
তুফানে আর কত লণ্ডভণ্ড হবে জীবন?
বগুড়া শহর শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক তুফান সরকার ও তাঁর সহযোগীরা এসএসসি পাস এক ছাত্রীকে ভালো কলেজে ভর্তি করার কথা বলে গত ১৭ জুলাই শহরের তাঁদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করেন। পরে এ ঘটনা কাউকে না জানাতে ভয়ভীতি দেখিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। ধর্ষণের ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে গত শুক্রবার (২৮ জুলাই) বিকেলে তুফান সরকারের স্ত্রী আশা ও তাঁর বড় বোন বগুড়া পৌরসভার সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলর মার্জিয়া আক্তার রুমকিসহ কয়েকজন মিলে ওই ছাত্রী ও তাঁর মাকে বেধড়ক পিটিয়ে মাথা ন্যাড়া করে দেন। এ ঘটনায় গত ৩০ জুলাই তাঁদের পুলিশ গ্রেপ্তার করলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে একে একে প্রকাশিত হয়েছে তাঁদের জীবনের নষ্ট গল্পগুলো। ক্ষমতার দাপটে গোটা বগুড়া শহরে বেপরোয়াভাবে নানা রকম কুকর্ম করেন তাঁরা।
তুফান সরকার
ছাত্রী ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনার মূল হোতা তুফান সরকার। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী খুন, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, দখলদারি সবকিছুই ডালভাত তাঁর কাছে। ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত হত্যা, হত্যাচেষ্টা, মাদক ব্যবসা ও চোরাচালানের ছয়টি মামলার আসামি এই তুফান সরকার। এর মধ্যে ২০১৫ সালে র্যাব কয়েক শ বোতল ফেনসিডিলসহ তুফান সরকারকে তাঁর বাসা থেকে গ্রেপ্তার করেছিল। এ ছাড়া ২০১৩ সালে যুবদল নেতা ইমরান হত্যা মামলারও আসামি তিনি।
ক্ষমতাসীন দলের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে ছয় বছরে গাড়ি, বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন। প্রশাসন আর নেতাদের হাতে রাখতে ঢেলেছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। ক্ষমতা আর অর্থের একচ্ছত্র দাপটে এত দিন নানা অপকর্ম করলেও দলীয় নেতাদের আশীর্বাদে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেছেন তিনি। নানা অপকর্মে জড়িত থেকেও বাগিয়েছেন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন শ্রমিক লীগের শহর শাখার শীর্ষ পদ।
তবে শুধু মাদক ব্যবসা নয়, শহরে ব্যাটারিচালিত প্রায় ২০ হাজার অটোরিকশা ও ভ্যান থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদা তুলতেন। শহরের চকসূত্রাপুর এলাকায় আলিশান বাসা তাঁর। শহরের চকযাদু ক্রস লেন সড়কে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। অস্ত্রধারী ক্যাডার নিয়ে চলাফেরা করেন। এত কিছুর পরও ক্ষমতাসীন দলের জেলার শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সখ্যের কারণে শ্রমিক লীগের পদ-পদবি বাগিয়েছেন তিনি। কিছুদিন আগেও শহর শ্রমিক লীগের সহসভাপতি ছিলেন। নেতাদের আশীর্বাদে কিছুদিন আগে কমিটির আহ্বায়কের পদ পান তিনি।
মারজিয়া হাসান রুমকি
ভগ্নিপতির ধর্ষণকাণ্ড ধাপাচাপা দেয়ার জন্য নির্যাতিতা ছাত্রী ও তার মাকে ডেকে নিয়ে মারধর এবং মাথা ন্যাড়া করে দেন বগুড়া পৌরসভার কাউন্সিলর মারজিয়া হাসান রুমকি। শুধু এলাকায় নয়; পৌরসভাতে ত্রাস হিসেবে পরিচিত তিনি। স্বামী ও পরিবারের সদস্যরা ক্ষমতাসীন দলের নেতা এবং বিত্তবান হওয়ায় তিনি কাউকে পাত্তাই দিতেন না। দৈনিক যুগান্তরের প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, পৌরসভার যেকোনো কাজের বিনিময়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়া, মাদক ব্যবসাসহ নানা রকম অনৈতিক কর্মকাণ্ডে মার্জিয়া জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
বেশ কয়েক বছর আগে রুমকি বগুড়া পৌরসভার নগর অংশীদারিত্বের মাধ্যমে দারিদ্র হ্রাসকরণ প্রকল্পের বাদুড়তলা কুলিপট্টি সিডিসির ক্যাশিয়ার ছিলেন। ওই সময় তিনি শুধু এলাকায় নয়; পৌরসভাতে গিয়েও ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদক বিক্রি করতেন। গত ২০১৫ সালে পৌরসভার নির্বাচনে ভগ্নিপতি ‘তুফান বাহিনীর’ সহায়তায় ২ নম্বর সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর হন রুমকি। এরপর থেকেই রুমকি বেপরোয়া হয়ে উঠেন।
পৌরসভায় সেবা নিতে আসা জনগণের কাছ থেকে জোরপূর্বক টাকা নেওয়া এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করতে শুরু করেন। বগুড়া পৌরসভার ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডে কোনো নাগরিক তার বাড়ি নির্মাণ, সংস্কারসহ অন্যান্য কাজ করলে রুমকিকে বাধ্যতামূলক চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে কাজ করতে দেন না তিনি। পৌর এলাকায় বিলবোর্ড স্থাপনসহ যে কোনো কাজে তাকে চাঁদা দেওয়া বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ গত ২৮ জুলাই ছাত্রী ও তার মাকে নির্যাতন এবং মাথা ন্যাড়া করে দিয়ে আলোচনায় এসেছেন কাউন্সিলর রুমকি।
তুফানের স্ত্রী আশা
বগুড়ায় ওই ছাত্রীকে ধর্ষণের পর তাকে ও তার মাকে মাথা ন্যাড়া করে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতনের মূল হোতা শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকারের স্ত্রী আশাও (২০) ও কম যান না। আশার বড় বোন মার্জিয়া হাসান রুমকি। স্বামী ও বড় বোনের দাপটে কাউকেই তোয়াক্কা করেন না তিনি। এই আশাই ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে বিচারের কথা বলে মা ও মেয়ে তুলে নিয়ে নির্যাতন করেন। মাথার চুল কেটে দেন।
নির্যাতিতা ছাত্রীর ভাষায়, ‘ওরা আমার ইজ্জতও কেড়ে নিল, আবার শালিসের নামে আমার ও আমার মায়ের মাথা ন্যাড়া করে দিল। এর ওপর রুমকি আপা (তুফানের স্ত্রীর বোন) বলেছেন, তোদের মারলে আমার কিছু হবে না। আমি তিনটি ওয়ার্ডের কমিশনার। পুলিশকে টাকা খাওয়াইলেই মামলা ডিসমিস হয়ে যাবে।’
কাউন্সিলর ‘রুমকি আপার’ অসীম ক্ষমতা-প্রভাব অন্যদিকে স্বামী তুফান সরকারের দাপটের কারণেই আশার মনে আশা জেগেছিল একবার পালিয়ে যাওয়ার। সে চেষ্টাও করেন তিনি। গেলেই আর কে ধরে? পুলিশের হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিলেই মামলা তো ডিসমিস!
এমন বিশ্বাস বুকে ধারণ করেই রোববার (৩০ জুলাই) সন্ধ্যায় বগুড়া থেকে একটি প্রাইভেটকারে করে তুফানের স্ত্রী আশা তার গাড়িচালক ও সহযোগীদের নিয়ে সন্ধ্যায় ঢাকার দিকে রওনা দেন। কিন্তু বিধি বাম! রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের হেমায়েতপুরে তাঁরা পুলিশের জালে পড়ে যান। তবে অনেকেই মনে করেন, পুলিশের এ জাল তারা ছিঁড়ে ফেলবেই। কেননা, এমন ঘটনা শুধু এই প্রথম নয়, এর আগেও তাঁরা ঘটিয়েছেন। সেই গতানুগতিক নিয়মেই বেঁচে গেছেন। আর এত অপরাধ করেও যারা পার পেয়ে যায় তারা বড় বড় অপরাধ করতেই অনুপ্রাণিত হয়।
তুফানের বড় ভাই মতিন
মতিনের হাত ধরেই অপরাধ জগতে তুফানের প্রবেশ বলে খবর প্রকাশ করেছে দৈনিক সমকাল। তারা লিখেছে, ২০ বছর আগে যুবলীগ নেতা মতিন যুবলীগের একজন সাধারণ কর্মী ছিলেন। পরে তিনি দলে 'অস্ত্রধারী ক্যাডার' হয়ে যান। ২০০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে শহরের নূরানী মোড় এলাকা থেকে পুলিশ নাইন এমএম পিস্তলসহ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এ মামলায় ২০০৪ সালে তার ২৭ বছরের কারাদণ্ড হয়। মাত্র কয়েক মাস কারাভোগের পর তিনি জামিনে বেরিয়ে আসেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মতিন ফের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। সংগঠনের ভেতরে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী গড়ে তোলেন। এ জন্য অর্থের প্রয়োজন হলে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। পাশাপাশি নিজ এলাকায় প্রকাশ্য জুয়ার আসরও বসান। জুয়া আর মাদকের টাকায় তিনি অল্পদিনের ব্যবধানে 'কোটিপতির খাতায়' নাম লেখান।
পরে ছোট ভাই তুফানকেও কাছে টেনে নেন। তাকে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও রিকশা-ভ্যান মালিক সমিতির নেতা বানিয়ে চাঁদাবাজির মাধ্যমে টাকা রোজগারের পথ করে দেন। মতিন সরকার এখন ৬৫ লাখ টাকা দামের গাড়িতে ঘুরে বেড়ান। শহরের একাধিক এলাকায় নামে-বেনামে কয়েক কোটি টাকার জায়গা-জমি রয়েছে। জেলা ট্রাক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেওয়া যুবলীগ শহর কমিটির যুগ্ম সম্পাদক আবদুল মতিন কিছুদিন আগে সংগঠনের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছিলেন। ওই পদে বিজয়ী হতে কয়েক লাখ টাকাও খরচ করেন। পরে কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত মতিন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন।
এখানেই শেষ নয়। মতিন ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে হত্যা ও মাদকের একাধিক মামলা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু হত্যা মামলাই রয়েছে চারটি। ১৯৯৮ সালের মাঝামাঝিতে শহরের নূরানী মোড় এলাকায় সংঘটিত রসুল হত্যাকাণ্ডে জড়িত মতিনের বিরুদ্ধে ২০০১ সালে উজ্জ্বল নামের এক যুবককে হত্যার অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া ২০১১ সালে শহরের মাটিডালি এলাকায় বাণিজ্য মেলায় শফিক চৌধুরী নামে স্থানীয় এক যুবলীগ নেতার খুনের সঙ্গেও তাঁর সম্পৃক্ততা রয়েছে। এরপর ২০১৩ সালের শেষ দিকে নিজ এলাকায় ইমরান হোসেন নামের এক যুবদল নেতার হত্যাকাণ্ডেও মতিনের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। ২০১২ সালে র্যাব অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ফেনসিডিল, ইয়াবা ও সাড়ে তিন লাখ টাকাসহ মতিন সরকারকে গ্রেপ্তারও করেছিল।
এমন সব কর্মকাণ্ডের ফলে ওই সব মানুষের ছবি ও নষ্ট গল্প আজ পুরো বাংলাদেশে সমালোচিত হচ্ছে। ছবিগুলো আজ সবার কাছে পরিচিতি লাভ করেছে। শুধু তুফান সরকাররা নন, যুগে যুগে এ রকম অনেক তুফান সরকারের দেখা মিলেছে আমাদের সমাজে। তাদের অত্যাচারে অসহায় ছিলেন এলাকাবাসী। এখনো হয়তো আরো অনেক তুফান সরকার আছেন আমাদের সমাজে। যাদের ছবি ও নষ্ট গল্পগুলো এখনো অপ্রকাশিত রয়েছে। ক্ষমতার জোরে নয়তো ভয়ভীতি দেখিয়ে কখনো প্রকাশ্যে, কখনো বা গোপনে নানা রকম কুকর্ম করছেন। পাপ যেহেতু গোপন থাকে না, তাই একদিন হয়তো অন্য কোনো তুফান সরকারদের ছবি ও নষ্ট গল্পগুলো আমরা জানতে পারব। কিন্তু আর কত? এদের উত্থান শেষ হবে কবে? কবে এদের হাত থেকে রেহাই পাব আমরা?
লেখক : শিক্ষার্থী ও প্রতিনিধি, বাংলাদেশ প্রতিদিন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়