ষোড়শ সংশোধনী
প্রশ্নবিদ্ধ রাজনৈতিক তৎপরতা
সর্বোচ্চ আদালতের কোনো রায় নিয়ে এতটা বিতর্ক অতীতে কখনো হয়নি––যা হচ্ছে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এমন অভিযোগও করেছেন যে, একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকের লেখা রায়ে সই করেছেন প্রধান বিচারপতি। সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছাড়া প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগ আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে কি না, তা আদালত ভালো বলতে পারবেন। মনে রাখা দরকার, যিনি এই মন্তব্যটি করেছেন, তিনি আদালত অবমাননার দায়ে সাজাপ্রাপ্ত।
প্রশ্ন উঠতে পারে, কোন সম্পাদকের প্রতি তিনি ইঙ্গিত করেছেন। রায়টি ইংরেজিতে লেখা হয়েছে। কোনো ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদক? দ্বিতীয় প্রশ্ন, অতীতে কি কখনো এমন হয়েছে যে, একজন সম্পাদক বা সাংবাদিক বা অন্য কোনো পেশার মানুষ রায় লিখে দিয়েছেন এবং বিচারপতি সেটিতে সই করেছেন? এটি কি আদৌ বাস্তবসম্মত কোনো কথা? কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের দায়িত্ববানরা এ রকম মন্তব্য হরহামেশাই করে থাকেন।
আদালত অবমাননার দায়ে সাজাপ্রাপ্ত আরেক মন্ত্রী কামরুল ইসলামও এই রায়ের সমালোচনা করতে গিয়ে বস্তুত প্রধান বিচারপতির বিষোদ্গারই করেছেন তা নয়, সেপ্টেম্বরে আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা আন্দোলনে নামবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। যদি সত্যিই তাই ঘটে, তাহলে দেশের মানুষ একটি নতুন ইতিহাসের সাক্ষী হবে।
সরকারের আরেক প্রভাবশালী মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী একে ‘মতলবি রায়’ মন্তব্য করে বলেছেন, এই রায় দূরভিসন্ধিমূলক এবং শেখ হাসিনাকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার ষড়যন্ত্র। এমনকি তিনি প্রধান বিচারপতিকে ইতিহাস পড়ে দেখারও আহ্বান জানান। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের সমালোচনা করতে গিয়ে মন্ত্রী এবং দেশের সবচেয়ে বড় ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের নেতারা যে ভাষা ব্যবহার করছেন, তা অনেক সময়ই শালিনতার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকছে না। যদিও নতুন প্রজন্ম তাদের আদর্শ মনে করে এবং তাঁরা জাতিকে পথনির্দেশ করেন।
তবে আরেকটি অভূতপূর্ব ঘটনা দেশবাসী দেখেছে যে, এই রায়ের পরে যখন সরকারের মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা প্রধান বিচারপতির সমালোচনায় মুখর, তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত শনিবার রাতে খোদ প্রধান বিচারপতির বাসভবনে নৈশভোজে অংশ নিয়েছেন। বৈঠকটি গোপন হলেও তা গণমাধ্যমের নজর এড়ায়নি। এমনকি ওবায়দুল কাদের নিজেও বিষয়টা অস্বীকার করেননি। বরং সোমবার রাজধানীর পলাশীর মোড়ে কেন্দ্রীয় জন্মাষ্টমী উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি বলেন, ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে তিনি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। শুধু তাই নয়, দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমতি নিয়েই তিনি প্রধান বিচারপতির কাছে গিয়েছিলেন দলের অবস্থান জানাতে। এরপর সোমবার তিনি রাষ্ট্রপতিকেও বিষয়টি অবহিত করতে বঙ্গভবনে যান। তবে ওবায়দুল কাদের মনে করেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে উদ্বেগ থাকতে পারে, কিন্তু শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
অতীতে কোনো রায় ঘোষণার পরে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক প্রধান বিচারপতির সঙ্গে এ রকম বৈঠক করেছেন বলে জানা যায় না। ফলে দেশের রাজনৈতিক ও বিচারিক ইতিহাসে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হয়ে থাকবে। বিশেষ করে কোনো রায় ঘোষণার পরে সেটি নিয়ে সরকারের বা ক্ষমতাসীন দলের উদ্বেগ অথবা অবস্থান জানাতে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে কোনো নেতার যাওয়াটা কতটা সমীচীন কিংবা আইনসঙ্গত––সেই প্রশ্নও ওঠা অসঙ্গত নয়।
প্রতিটি রায়েরই পক্ষে-বিপক্ষে মতামত থাকে। রায়টি যাদের পক্ষে যায় তারা খুশি হয় এবং যাদের বিপক্ষে যায় তারা সংক্ষুব্ধ হয় এবং সেই সংক্ষুব্ধতার প্রতিকার চাওয়ার বিধান খোদ আইনেই বলা আছে। অর্থাৎ ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে সরকারের বা ক্ষমতাসীন দলের যদি কোনো আপত্তি থাকে, সেক্ষেত্রে তারা রিভিউ করতে পারেন। এমনকি আইনমন্ত্রী এবং অ্যাটর্নি জেনারেল যেমনটি বলেছেন যে, তারা রায়ের পর্যবেক্ষণের কিছু অংশ এক্সপাঞ্জ বা প্রত্যাহারের আবেদন জানাবেন––সেটিও যুক্তিযুক্ত। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে যাওয়া এবং সেটি রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করা দেশের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। নিশ্চয়ই এর পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি রয়েছে। এটি নিয়ে বরং একাডেমিক আলোচনাও বাঞ্ছনীয়।
১৪ দলের মুখপাত্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও এই রায়ের কড়া সমালোচনা করে বলেছেন, ‘বৈধ সংসদ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু নিয়ে রায়ে যে পর্যবেক্ষণ রয়েছে, তা ১৪ দল প্রত্যাখ্যান করছে। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু নিয়ে রায়ে যা বলা হয়েছে, তা জনগণ মেনে নেবে না, ক্ষমা করবে না। সুতরাং এ রায়ের পুনর্বিবেচনা জরুরি।’
তবে সংসদের বাইরে থাকা সবচেয়ে বড় বিরোধী দল বিএনপি এই রায় নিয়ে এতটাই উচ্ছ্বসিত যে, অনেকের মনে হতে পারে, এই রায়ের মধ্য দিয়ে আগামী নির্বাচনে বোধ হয় তাদের জয়ী হওয়ার নিশ্চয়তা মিলেছে। মনে রাখা দরকার, এই রায়ে আদালত যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, সেখানে দেশের সব রাজনৈতিক দলের, রাজনৈতিক পদ্ধতির এবং সংসদীয় গণতন্ত্র শক্তিশালী করার ব্যর্থতায় অতীতে ক্ষমতাসীন সব দলকেই আদালত দায়ী করেছেন। এটি ভাবার কোনো কারণ নেই যে, ২০১৭ সালে এই রায় দেওয়া হয়েছে বলে কেবল আওয়ামী লীগকেই দোষারোপ করা হয়েছে। বরং এই রায় সব রাজনৈতিক দলের জন্যই একটি আয়না; যদি রাজনীতিকরা এটিকে আয়না হিসেবে মেনে নিয়ে সেখানে নিজেদের চেহারা দেখার চেষ্টা করেন এবং নিজেদের ভুলত্রুটিগুলো শুধরে নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক হন, সেটি তাদের নিজেদের জন্য তো বটেই, দেশের জন্যও মঙ্গলজনক।
পরিশেষে এটা বলা উচিত যে, রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের মধ্যে এ রকম টানাপড়েন অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। বরং মাঝেমধ্যে বিচার ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে এ রকম দ্বন্দ্ব তৈরি হলে সেখানে অনেক বিষয় উঠে আসে, অনেক না বলা কথা বিচারকরা বলার সুযোগ পান আবার রাজনীতিকরাও নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে পারেন। সুতরাং এই বিতর্ককে আমরা বরং সাধুবাদ জানাই। তবে বিতর্কটি যাতে ব্যক্তিগত আক্রমণে পর্যবসিত না হয় এবং সবকিছুর মধ্যে আমরা যেন ষড়যন্ত্র না খুঁজি, সে বিষয়েও সতর্ক থাকা দরকার।
লেখক : সাংবাদিক।