সাংবাদিকতা
দেশি ও বিদেশি গণমাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট
সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা ইস্যুতে দেশে ও বিদেশে আমরা কী ধরনের সাংবাদিকতা করতে পারছি বা কী ধরনের সাংবাদিকতা করা সম্ভব হচ্ছে, এটি এখন একটি বড় ধরনের একাডেমিক তর্কের বিষয় হতে পারে বলে মনে হয়।
কোনো একটি বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার প্রথম শর্ত প্রত্যক্ষদর্শীর ‘সঠিক’ বয়ান অথবা ঘটনাস্থলে রিপোর্টারের উপস্থিতি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে দ্বিতীয়টির তীব্র অনুপস্থিতি শুরু থেকেই। বাংলাদেশের সাংবাদিকরা তো বটেই, মিয়ানমারের সাংবাদিকরাও ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাখাইন প্রদেশে যাওয়ার অনুমতি পান না। সেখানে বিবিসি, আলজাজিরা, রয়টার্সের মতো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের প্রবেশও যথেষ্ট সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত। ফলে সেখান থেকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কর্মীরা যে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ দেবেন, সেই সম্ভাবনা কম। মনে রাখা দরকার, মিয়ানমারের সরকার রাখাইনে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশ করতে দেয় না মানেই হলো সেখানে তারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্মম নির্যাতন চালাচ্ছে এবং তাদের সেই বীভৎসতা যাতে বিশ্ববাসী জানতে না পারে, সেই কৌশলের অংশ হিসেবেই রাখাইন বলা চলে সাংবাদিকদের জন্য একপ্রকার ‘নিষিদ্ধ জোন’।
মিয়ানমারের স্থানীয় সংবাদপত্রে রোহিঙ্গা ইস্যুতে যেসব খবর প্রকাশিত হয়, তা পড়লে বোঝা যায়, হয় এই ইস্যুতে সে দেশের সাংবাদিকরা যথেষ্ট ‘জাতীয়তাবাদী’ অথবা রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত। ফলে বাংলাদেশের এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি সাংবাদিকদের এখন মূল ভরসা রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারাই। তারা প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে যা পাচ্ছেন, তার বাইরে খুব বেশি অনুসন্ধানের সুযোগ কম। আর যখন কোনো একটি বড় ঘটনায় তথ্য কম থাকে বা কম জানা যায়, তখন বিভ্রান্তিকর তথ্যের ডালপালা ছড়ায় বেশি। যার একটি বড় উদাহরণ আমরা দেখেছি ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহের সময়। অর্থাৎ এই তথ্যশূন্যতা বা তথ্যের অপ্রতুলতাই এখন রোহিঙ্গাবিষয়ক সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
তবে কিছু সংবাদ মিলবে মিজিমা (http://www.mizzima.com) নামে একটি অনলাইন সংবাদপত্রে। তাদের একটি খবরে বলা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের খবর সেন্সর করায় মিয়ানমারের জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল এমএন টিভির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে বিবিসি। ২০১৪ সালের এপ্রিলে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী বিবিসি বার্মিজ ভাষার জনপ্রিয় চ্যানেল এমএন টিভির অনুষ্ঠান সম্প্রচার করত। ৩৫ লাখের বেশি দর্শক এই টিভি দেখত। তবে ঠিক কোন অনুষ্ঠানটি সেন্সর করা হয়েছিল, বিবিসি তা উল্লেখ করেনি। এ প্রসঙ্গে বিবিসি বলছে, "The BBC cannot accept interference or censorship of BBC programs by joint-venture TV broadcasters as that violates the trust between the BBC and its audience."
মিজিমার ওই সংবাদে বলা হয়েছে, Myanmar's government— and most local media– call them (Rohingya) Bengalis, portraying them as illegal immigrants from Bangladesh despite many living in the country for generations. অর্থাৎ মিয়ানমার সরকার ও স্থানীয় গণমাধ্যমও তাদের (রোহিঙ্গা) বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে আসা বাঙালি বলে উল্লেখ করে, অথচ তাদের অনেকেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রাখাইনে বসবাস করছে।
তবে শুধু মূলধারার গণমাধ্যমই নয়, রাখাইনে রোহিঙ্গাবিষয়ক বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পাওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ ফেসবুক। পাঠকের মনে থাকার কথা, একবার ফেসবুকে অং সান সু চির একটি ছবি ভাইরাল হয়েছিল, যেখানে তার একটি হিজাব পরা ছবি দিয়ে লেখা হয়েছিল, মুসলমান হলেন অং সান সু চি। গত বছরের অক্টোবরে রাখাইনে সেনা অভিযানের সময় অসংখ্য মানুষের খণ্ড-বিখণ্ড আর পুড়িয়ে দেওয়া লাশের ছবিও ভাইরাল হয়েছিল। দাবি করা হয়েছিল, ওই লাশগুলো রোহিঙ্গা মুসলমানদের। কিন্তু ছবিগুলো আসলেই রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর পাশবিকতার কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অর্থাৎ ফেসবুকের কারণে এখন সবকিছুই দ্রুত মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে এটা যেমন ঠিক, তেমনি অনেক বিভ্রান্তিরও জন্ম হচ্ছে। এমন অনেক ভুলভাল তথ্য কিছু ছড়িয়ে যাচ্ছে, যা বিশ্বাস করার লোকেরও অভাব নেই। এই সংকট মোকাবিলার উপায় তাহলে কী?
৩ সেপ্টেম্বর বিবিসির এক খবরে বলা হয়েছে, রাখাইন প্রদেশের বৌদ্ধদের সঙ্গে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের সংঘাত বহুবার মারাত্মক দাঙ্গার চেহারা নিয়েছে। কিন্তু এসব এলাকায় সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার অত্যন্ত সীমিত, আর ঘটনা সম্পর্কে তথ্যও পাওয়া যায় খুবই কম। যাঁরা সেখানে যেতে পেরেছেন, তাঁরাও দেখেছেন যে পরিস্থিতি এবং দুই সম্প্রদায়ের বৈরিতার কারণে তথ্য সংগ্রহ করাও খুব কঠিন।
বিবিসির জোনাহ ফিশার গিয়েছিলেন রাখাইনে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে রিপোর্ট করতে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তাকে সংকটাপন্ন এলাকায় যেতে বাধা দেওয়া হয়। জোনাহ লিখেছেন, ‘রাখাইন রাজ্যে কী ঘটছে, তার উত্তর নির্ভর করছে আপনি কাকে বিশ্বাস করবেন তার ওপর। কারণ কেউ যে স্বাধীনভাবে সেখানে গিয়ে প্রকৃত ঘটনা জানবেন, তার সব পথ বন্ধ রেখেছে মিয়ানমার সরকার।’
তিনি লিখছেন, ‘সাংবাদিক এবং ত্রাণকর্মীরা যেহেতু রাখাইনে যেতে পারছেন না, তাই রোহিঙ্গারা নিজেরাই সেখানে অত্যাচার-নির্যাতনের ছবি তুলে ধরছেন। তাঁরা স্মার্টফোনে তাঁদের কাহিনী বর্ণনা করে বিভিন্ন মেসেজিং অ্যাপ ব্যবহার করে পাঠিয়ে দিচ্ছেন বিদেশে।’
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গত মাসের ২৫ তারিখ থেকে শুরু হওয়া সহিংসতার পর এখন পর্যন্ত ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা দেশত্যাগ করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তবে তাদের নিবন্ধন না হলে সঠিক সংখ্যা জানা যাবে না। অতীতেও যখন রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে এসেছে, তাদের সবাই নিবন্ধনের আওতায় আসেনি। ফলে দেখা যায়, বাংলাদেশে বৈধ-অবৈধ রোহিঙ্গাদের যে সংখ্যা সরকারের তরফে বলা হয়, বেসরকারি নানা হিসাবে সেটি আরো বেশি। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে এটিও একটি চ্যালেঞ্জ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে যে উত্তেজনা চলছে, বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো তার সীমিত সাধ্য নিয়ে সেগুলো কাভার করার চেষ্টা করছে এটা ঠিক; কিন্তু এ রকম একটি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সমস্যাকে সাংবাদিকরা কতটা আন্তর্জাতিক মানের করে পরিবেশন করতে পারছেন, এই ইস্যুতে শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারত ও চীনের ভূমিকা নিয়ে কতটা নিরপেক্ষ সমালোচনা করতে পারছেন, আঞ্চলিক বিভিন্ন জোট ও রাষ্ট্রগুলোর কূটনীতি এ ক্ষেত্রে আদৌ কোনো কাজ করছে কি না, তার বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা ও সমালোচনা আমাদের গণমাধ্যম করতে পারছে কি না, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে এবং সীমান্তে একটা যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে বলে শোনা যাচ্ছে, সেসব ইস্যুতে আমাদের গণমাধ্যম কতটা বস্তুনিষ্ঠ আর সাহসী ভূমিকা রাখতে পারছে, সেসব নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনার সময় হয়েছে বলে মনে হয়।
মিয়ানমার সরকার যে রাখাইনে রোহিঙ্গা এবং সেখানে থাকা অন্যান্য সংখ্যালঘু যেমন হিন্দুদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করবে না, বরং তাদের জাতিগতভাবে নির্মূল করতে বদ্ধপরিকর––তাই এ মুহূর্তে রাখাইন প্রদেশে যাতে অন্তত বিদেশি সাংবাদিকরা যেতে পারেন, সে ব্যাপারে জাতিসংঘের উচিত হবে মিয়ানমার সরকারের ওপর জোরালো চাপ সৃষ্টি করা। তবে জাতিসংঘের সেই চাপকে যে মিয়ানমার বুড়ো আঙুল দেখাবে, সেই শঙ্কাও রয়েছে। কারণ, মিয়ানমারের পাশে রয়েছে শক্তিশালী চীন, তারা অস্ত্র পাচ্ছে ইসরায়েল থেকে। আর রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের ভূমিকাও খুব আশাব্যঞ্জক নয়। সুতরাং রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সঙ্গে শেষমেশ মিয়ানমারের সম্পর্ক কতটা অবনতি হয়, সেদিকেই বরং এখন আমাদের নজর রাখা দরকার।
লেখক : সাংবাদিক।