অভিমত
দুর্গাপূজা ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ
‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’—এটি সম্প্রীতির বাংলাদেশের সময়োপযোগী ও জনপ্রিয় স্লোগান। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ ও জাতি-গোষ্ঠীর লোকের বসবাস। এখানে একই সময়ে একদিকে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ঈদ উৎসব পালিত হয়, অন্যদিকে হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা উদযাপন হতে দেখা যায়। এবারে ২০১৭ সালেও শারদীয় দুর্গোৎসব পালিত হচ্ছে ২৬ সেপ্টেম্বর মহাষষ্ঠীর মাধ্যমে এবং প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে তা শেষ হচ্ছে ৩০ সেপ্টেম্বর। ঠিক তার পরদিনই, অর্থাৎ ১ অক্টোবরেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে মুসলমানদের ধর্মীয় আরেক গুরুত্বপূর্ণ দিন পবিত্র আশুরা।
হিন্দুধর্মীয় ১২ মাসের তেরো পূজা-পার্বণের মধ্যে দুর্গাপূজা ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পালিত হয়ে থাকে। আর পূজার প্রতিমা বিসর্জনের দিন, অর্থাৎ বিজয়া দশমীর দিনের আগে ধারাবাহিকভাবে কিছু রীতি পালন করা হয়ে থাকে। তবে তার মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্গাপূজা শুরু হয় প্রথমে মহালয়া এবং তার পরে মহাষষ্ঠীর মাধ্যমে। এবারে ২৬ সেপ্টেম্বরের মহাষষ্ঠীর আরাধনার মাধ্যমে শুরু হয়েছে দেবীদুর্গার আগমনের শুভক্ষণ। এবারে ধর্মগুরুদের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী দেবীদুর্গা আসবেন নৌকায় করে এবং যাবেন ঘোড়ায় চড়ে।
আক্ষরিক অর্থে ‘দুর্গা’ শব্দের অর্থ হলো আবদ্ধ স্থান। যা কিছু দুঃখ-কষ্ট মানুষকে আবদ্ধ করে, যেমন—ভয়, দুঃখ, শোক, জ্বালা, যন্ত্রণা এসব থেকে তিনি ভক্তকে রক্ষা করেন। তবে শাস্ত্রকাররা দুর্গার আরো একটি অর্থ করেন। দুঃখের দ্বারা যাকে লাভ করা যায়, তিনিই দুর্গা। দেবী দুঃখ দিয়ে মানুষের সহ্যক্ষমতা পরীক্ষা করেন। তখন মানুষ অস্থির না হয়ে তাঁকে ডাকলেই তিনি তার কষ্ট দূর করেন। উমা থেকে পার্বতী এবং তারপর পার্বতী থেকে দুর্গা। এই নামেই তিনি বেশি পরিচিত। পুরাণে আছে, তিনি গিরিরাজ হিমালয়ের কন্যা এবং পর্বতের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, তাই তিনি পার্বতী। পরের অধ্যায়ে তিনি হয়ে ওঠেন দানব দলনী দশভুজা। আর তখনই তার নাম হয় দুর্গা। বহু সমস্যার সমাধানের চিরায়ত মা দুর্গতিনাশিনী দুর্গারূপে আবির্ভূত হন।
মূল দুর্গাপূজার আসল সময় ছিল বসন্তকালে। কিন্তু বিপদে পড়ে রামচন্দ্র রাজা সুরথ বৈশ্য সমাধি বসন্তকাল পর্যন্ত অপেক্ষা না করে শরতেই দেবীকে অসময়ে জাগ্রত করে পূজা করেন। সেই থেকে অকালবোধন হওয়া সত্ত্বেও শরৎকালে দুর্গাপূজা প্রচলিত হয়ে যায়। তাই এটি শারদীয় দুর্গাপূজা। আর বসন্তকালে দুর্গাপূজা হলে সেটি হয় বাসন্তী দুর্গাপূজা।
বাংলাদেশ যে বিশ্বে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সবচেয়ে বড় উদাহরণ তার একটি প্রমাণ হলো প্রতিবছরই পূজামণ্ডপের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বছর (২০১৭) ঢাকা মহানগরে ২৩১টি পূজামণ্ডপসহ সারা দেশে ৩০ হাজার ৭৭টি পূজামণ্ডপে পালিত হচ্ছে দুর্গাপূজা। গতবছর (২০১৬) সারা দেশে পূজামণ্ডপ ছিল ২৯ হাজার ৩৯৫টি এবং ঢাকা শহরে ছিল ২২৯টি, যা যথাক্রমে ৬৮২টি এবং দুটি করে বেড়ে গেছে। তবে সরকারের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর তরফ থেকে পুরোমাত্রায় আশ্বস্ত করা হয়েছে যে বাড়তি এসব পূজামণ্ডপের জন্য অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে দেশজুড়ে।
এবারের শারদীয় দুর্গাপূজার অনুষ্ঠানটি এমন একটি সময়ে হচ্ছে যখন দেশে একের পর এক বেশ কয়েকটি সমস্যা আঘাত করেছে। প্রথমটি ছিল ধানের দেশখ্যাত দেশের পূর্বাঞ্চলের হাওর এলাকায় আগাম বন্যায় ধান ও মাছের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। তারপর আসে দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৭টি জেলায় ভয়াবহ বন্যায় ব্যাপক ফসলহানি ও ক্ষয়ক্ষতি। এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবার কোরবানির ঈদের কয়েক দিন আগে থেকে শুরু হয়েছে মিয়ানমার থেকে বানের জলের স্রোতের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থীর আগমন। আর এ শরণার্থীর আগমন শুধু স্বাভাবিক কোনো আগমন নয়। সর্বকালের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে আগের থাকা পাঁচ লাখের সঙ্গে আরো প্রায় পাঁচ লাখ শরণার্থী যোগ হয়ে গেল চোখের পলকে।
কাজেই আগে যেহেতু বন্যার ক্ষয়ক্ষতি পূরণের নিমিত্তে দেশের সবাই মিলেই সেই সমস্যার সমাধানের দ্বারপ্রান্তে, তখন রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানেও সবাই একইভাবে এগিয়ে আসছে। তারই অংশ হিসেবে এবারে সারা দেশে দুর্গাপূজায় খরচ বাঁচিয়ে সাশ্রয় করে তা রোহিঙ্গাদের সাহায্যে ব্যবহার করার মানবিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি মহৎ সিদ্ধান্ত। কারণ আমরা জানি, সব ধর্মেরই মূল বাণী হলো মানবপ্রেম এবং মানবতা। যেখানে মানবতা দুমড়েমুচড়ে পড়ে, সেখানে আনন্দ-উল্লাস বাতুলতা মাত্র। এটাকেই উপলব্ধিতে নিয়ে দুর্গাপূজা পালন করা হচ্ছে এবার। আর ঠিক একইভাবে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে সব নেতিবাচক চিন্তা পরিহার করে পবিত্র আশুরা পালিত হবে দুর্গাপূজার ঠিক পরের দিন, অর্থাৎ ১ অক্টোবর রোববার।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।