অভিমত
এভ্রিলদের জয় অথবা সুন্দরী প্রতিযোগিতার পরাজয়
এভ্রিল নামটা কখনো শুনেছি, মনে পড়ছে না। আমেনাকে তো চিনিই না। মাস চারেক আগে জান্নাতুল নাঈমকে দেখেছিলাম।
সাদা বাংলায় বললে অপলক নয়নে! অবাক হয়ে দেখছিলাম, একটা পুঁচকে মেয়ে, কেমন করে হাইওয়েতে, হাই স্পিডে বাইক চালাচ্ছে। চালানোটাও যেন একটা শিল্প! বাইকের মতো একটা ‘পান্ডা’ যানবাহনকে মেয়েটি ওর ‘খেলার পুতুলে’ পরিণত করেছে রীতিমতো।
সেসব দেখার সৌভাগ্য হয়েছে ইউটিউবের কল্যাণে। তারপর নিজের দৈনন্দিন ‘যাপনের তলায়' চাপা পড়ে গেছে নাঈমার নাম!
হঠাৎই দেখলাম আবারও। ‘মিস ওয়ার্ল্ড, বাংলাদেশ'-এর উত্তরীয় গায়ে জড়ানো। মাথায় মুকুট!
এবার আরো অবাক হলাম! একজন বাইকার, ইয়াহামা ব্র্যান্ডের অ্যাম্বাসাডর, প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা মেয়েটি সুন্দরী প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়েছে! জিতেও গেছে।
শোনা যাচ্ছে, সেই জেতাটা, ঠিক জেতা নয়! জান্নাতুল নাঈম এভ্রিল তথ্য গোপন করেছে। প্রতিযোগিতার শর্ত ভঙ্গ করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে, সেটাই জানিয়ে দিয়েছেন আয়োজকরা। অতঃপর এভ্রিল বাদ পড়েছে। এখন ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ হিসেবে নাম এসেছে জেসিয়ার।
এভ্রিলের নাম বিশ্ব সুন্দরীর তালিকায় আর রইল না।
হেরে গেল এভ্রিল?
বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতার শর্ত, বিবাহিত হওয়া চলবে না। শর্ত, বিকিনি পরা কোনো ‘আপত্তিকর’ ছবি আগে প্রকাশিত হতে পারবে না। অথচ এই প্রতিযোগিতায় ‘বিচ রাউন্ড' বলে একটা অধ্যায় আছে, যেখানে এই পোশাকই পরতেই হয়!
এই নিয়মগুলো বিশ্বের ‘বাজার অর্থনীতি' নির্ধারণ করে। তাতে করে ওই সুন্দরীর ‘বাজারমূল্য' আকাশচুম্বী হয়! পণ্য হিসেবে বেশ চড়া মূল্যে বিক্রি করা যায় মেয়েটিকে।
এত সব কারণেই আমি এভ্রিলের পরাজয় দেখতে পেলাম না। পরাজয় দেখলাম এই ‘ব্যবস্থা'টার।
জান্নাতুল নাঈম এভ্রিল। খুব সাধারণ একটা মেয়ে। লড়াই করছে নিজের পরিবারের সঙ্গে। সমাজের সঙ্গে। সংগ্রাম করছে ‘শূন্য থেকে গন্তব্যে' পৌঁছানোর জন্য। চেষ্টা করছে শত অপমানেও প্রাণস্পৃহা অটুট রাখতে! লড়াই করছে ‘চাকচিক্যের কদর’ওয়ালা সমাজে নিজের কদর বাড়াতে!
তাই গতকাল সংবাদ সম্মেলনের পর্দা যখন পড়ল, যেন দেখতে পেলাম, সমাজের ‘ব্যবস্থাটাকে' বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে যাচ্ছে দুর্দান্ত ‘জীবনযোদ্ধা' মেয়েটি।
শুধু আজকের বাংলাদেশের এভ্রিলই নয়, এই প্রতিযোগিতার সঙ্গে, সমাজের ‘দ্বন্দ্বমূলক বাস্তবতা'র রূপটি আরো অনেকেই উন্মোচন করেছেন।
মারজোকি ওয়ারল্যাস। যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা। ১৯৭৩ সালে মিস ওয়ার্ল্ড হলেন। তার পর খেতাব কেড়েও নেওয়া হলো তাঁর। কারণ, মারজোকিও বিবাহিত ছিলেন। আর এভ্রিলের মতো তিনিও তথ্য গোপন করেছিলেন।
যদি ‘অবিবাহিত’ হওয়ার শর্তটা না থাকত, তবে? মারজোকি হারতেন?
পরের বছরে, ১৯৭৪ সালে জয়ী হলেন হেলেন মরগ্যান! যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা! তাঁর অপরাধ, তিনি কুমারী মাতা, তার একটি পুত্র আছে—এই তথ্য গোপন করেছিলেন।
আমি যিশুকে স্মরণ করি! হে যিশু, জয়টা তবে কার?
১৯৮০ সালেও জার্মানির গ্যাব্রিয়েলা ব্রুমের কাছ থেকে মিস ওয়ার্ল্ডের মুকুট ফিরিয়ে নেওয়া হলো। না, তিনি বিবাহিত ছিলেন না। ছিলেন না কুমারী মাতা! তাঁর একজন প্রেমিক ছিল। তিনিই গ্যাব্রিয়েলের পদকপ্রাপ্তিতে অসন্তুষ্ট ছিলেন! সম্পর্ক বাঁচাতে গ্যাব্রিয়েলাও সবটা মেনে নিলেন।
ইসরায়েলের সুন্দরী লাইনর অবরগিল। ১৯৯৮ সালের মিস ওয়ার্ল্ড নির্বাচিত হলেন। দুদিন পরেই ছিঃ ছিঃ চারদিকে! জয়ী হওয়ার ঠিক দুই মাস আগে লাইনর ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন।
বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতার আগে লাইনর মিস ইসরায়েল হিসেবে বিজয়ীর মুকুট পরেন। জয়ী হয়ে তিনি বলেন, এ প্রতিযোগিতায় তিনি অংশগ্রহণ করতে চাননি। কিন্তু জয়ী হলে থাইল্যান্ডে ভ্রমণ করতে পারবেন, সঙ্গে জুটবে একটা নতুন গাড়ি। দুটোই ছিল তাঁর কাছে বেশ লোভনীয়!
লাইনরের ধর্ষকের বিচার হয়েছিল। ২০০৫ সালে ইসরায়েলের ‘সর্বকালের সেরা ব্যক্তিত্বে'র তালিকায় তিনি ৮৯তম হয়েছিলেন।
তবে হলো কী? মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতার নিয়মে তো ‘কুমারী’ হওয়ার শর্ত ছিল! তাহলে এই ‘শর্ত'টা পরাজিত হলো নাকি?
বাকি গল্প ২০১৩ সালের। ইন্দোনেশিয়ার জার্কাতার সেন্টুলে ছিল বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতার মূল ভেন্যু। কিন্তু বাধার মুখে বালিতে প্রতিযোগিতা সরিয়ে নেওয়া হয়। বড়সড় একটা পরিবর্তনও আসে প্রতিযোগিতাটির। সেই প্রথম প্রতিযোগীরা বিকিনি না পরে ‘বিচ ফ্যাশন রাউন্ডে' বালির ট্র্যাডিশনাল পোশাক পরে অংশগ্রহণ করেন। কারণটা স্বীকার না করে আয়োজকরা বলেছিল, সুন্দরী প্রতিযোগিতা কেবল প্রতিযোগীদের সৌন্দর্যের বিষয় না, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধও এর বিবেচ্য!
অথচ ১৯৮০ সালে বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতার উপজীব্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছিল ‘সৌন্দর্যই উদ্দেশ্য'। আর এর গোড়াপত্তনের সময় (১৯৫১ সালে) এরিক মোর্লে সিদ্ধান্ত নেন, সাঁতারের পোশাক প্রদর্শনীটি প্রতিবছর জনসমক্ষে মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতা হিসেবে নিয়ে আসবেন। মূলত বিকিনি প্রতিযোগিতা উৎসবকে প্রতিপক্ষ করেই চালু করা হয় এটি।
নিজেদের মূলনীতির একেবারে বিপরীতমুখী অবস্থানে চলে গেল ২০১৩ সালে। শুধু সেই সময়ে নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য!
তাহলে পরাজয় ঘটছে কাদের? হেলেন, মারকোজি, গ্যাব্রিয়েলা, লাইনর বা এভ্রিলদের? যাঁরা তথ্য গোপন করেন। প্রতিযোগিতার শর্ত পূরণ না করেই প্রতিযোগিতায় নাম লেখান?
না, পরাজয় আয়োজকদের। আর তাদের ‘বাজারি নীতি'র এই সস্তা প্রতিযোগিতার। তাই বারবার এই প্রতিযোগিতার মূলনীতিকে ধাক্কা দিতেই এভ্রিলরা মঞ্চে ওঠেন।
আপাতদৃষ্টিতে হারলেও বিজয় পতাকা (দেখা যায় না, অনুভব করতে হয় এ পতাকা) হাতে নিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে আসেন।
লেখক : গবেষক