অভিমত
রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয়ণ ও পরিবেশ বিপর্যয়
সাম্প্রতিককালে রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে এক বিষফোড়া হিসেবে দেখা দিচ্ছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে হিমশিম খেয়ে টালমাটাল অবস্থায় আছে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকা টেকনাফ, উখিয়াসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান। কুতুপালং, বালুখালীসহ অন্য যেসব স্থানে এ বিপুল পরিমাণ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে, তাতে এরই মধ্যে সেসব এলাকায় দেখা দিয়েছে নানা রকম পরিবেশ বিপর্যয়কর পরিস্থিতি।
বিশেষ করে এবারের রোহিঙ্গার ঢলে যে এলাকাগুলোতে শরণার্থীরা আশ্রয় গ্রহণ করেছে, সেগুলো মূলত সীমান্ত এলাকার প্রাকৃতিক বন ও পাহাড়ি এলাকা। সেখানে বন্যহাতির অভয়ারণ্যসহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য রয়েছে, যেগুলো শরণার্থীদের কলরবে এখন ক্ষণে ক্ষণে মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। শুধু হুমকির মুখেই বা বলছি কেন, এরই মধ্যে সেখানে গেলে দেখা যাবে সেখানকার অনেক প্রাকৃতিক পরিবেশের বিপর্যয় হয়ে গেছে।
সেখানে বন-জঙ্গল কেটে সাফ করে করে পাহাড় কেটে কেটে মাটি সরিয়ে তাঁবু টানিয়ে বসতি স্থাপন করছে লাখ লাখ শরণার্থী। একসঙ্গে এতগুলো মানুষের আনাগোনা, চলাফেরা, বসতি স্থাপন তাও আবার অল্প দু-একটি উপজেলার সামান্য একটু স্থানে সংকুলান করা সহজ কথা নয়। রোহিঙ্গাদের তাদের দেশ মিয়ানমারে সেনাবাহিনী কর্তৃক মারাত্মক নির্যাতনের কারণে তারা দলে দলে আমাদের দেশে শরণার্থী হচ্ছে এবং বাংলাদেশ সরকার তাদের মানবিক দিক বিবেচনায় আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে, সেটা খুবই ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু তাদের জন্য সেখানকার হাজারো বছরের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য যে সমস্যার মধ্যে পড়েছে, সেটাকে এখনই বিবেচনায় নিয়ে আসতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে তা আরো ব্যাপক ক্ষতির দিকে চলে যাবে।
আমাদের সেটা ভুলে গেলে চলবে না যে পুরো কক্সবাজার এলাকাই হলো দেশের জন্য একটি গৌরবের বিষয়। কারণ, সেখানকার বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ও দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত আমাদের দেশের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ। তা ছাড়া অতিসম্প্রতি বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন ভাবনাটাও ঠিক সেই একই জায়গাজুড়ে। সেখানে সমুদ্রসৈকতকে ঘিরে পর্যটনকে আরো আকর্ষণীয় করার মানসে তিনি ৮০ কিলোমিটারের মেরিন ড্রাইভ চালু করেছেন। জায়গাটা শুধু পাহাড়ের এপাশ আর ওপাশ তফাৎ মাত্র। এখন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়ের জন্য সেই পাহাড় ও বন কেটে সাবাড় করে দিয়ে তাদের বাসস্থান তৈরি করা হচ্ছে। যদিও বিভিন্ন মাধ্যমে বলা হচ্ছে, খুব তাড়াতাড়ি কিংবা আগামী মাত্র এক বছরের মধ্যেই এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়ে যাবে এবং রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু অতীতের অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস তা বলে না।
আমরা দেখেছি, গত ৩০ বছরেও এ সমস্যার কোনো সমাধান তো হয়ইনি, বরং আগের পাঁচ লাখের সঙ্গে নতুন করে ঢুকে গেছে আরো পাঁচ লক্ষাধিক শরণার্থী। আর তা এখনো থামছে না, বরং বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে তা কোথায় এসে ঠেকবে, তা অনুমান করা কঠিন। শরণার্থীদের প্রয়োজনেই পানির জন্য বসানো হচ্ছে নলকূপ, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জন্য বসানো হচ্ছে হাট-বাজার, রান্নাবান্নার জন্য বসানো হচ্ছে চুলা। সেসব চুলায় রান্নার জন্য প্রয়োজন লাকড়ি-জ্বালানি। আর সেসব লাকড়ি-জ্বালানির জন্য উজাড় করছে আরো প্রাকৃতিক বন-জঙ্গল। আর শুধু লাকড়ি-জ্বালানি নয়, তাঁবু তৈরিতেও ব্যবহৃত হচ্ছে সেসব বনের বাঁশ-কাঠ। তাতে একদিকে বন-পাহাড় কেটে বাসস্থান তৈরি করা হচ্ছে, অন্যদিকে সেসব বাসস্থানের মানুষের প্রয়োজনে আবার উজাড় করা হচ্ছে প্রকৃতিক বন-জঙ্গল, সর্বোপরি নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ।
এতে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, সেখানে বন্যহাতিসহ অন্য বন্যপশুরা অভয়ারণ্য ছেড়ে বাইরে চলে আসছে, যাতে তাৎক্ষণিক অনেক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। এতে একদিকে যেমন বন্যপশুদের নিরাপত্তার সমস্যা হয়, অন্যদিকে সেসব লোকালয়ের মানুষকেও নানামুখী সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। এখানে একটি বিষয় খুব ভালোভাবে খতিয়ে দেখা দরকার যে আসলে আমাদের বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের পর্যটন সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করার কোনো চক্রান্ত শুরু হয়েছে কি না। কারণ দেখা যাচ্ছে, ঠিক যে সময়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীর বিষয়টিকে একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে, সেটা রোধ করার জন্য বিশ্বজনমত একীভূত হয়েছে। ঠিক তখনই আবারও মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন করে পাঠিয়ে দেওয়া কোনো অবস্থাতেই ভালো লক্ষণ বহন করে না।
সে জন্য সরকারের নমনীয় ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সেখানে তাদের প্রতি অবিচার করা যাবে না। তবে দেশটি আমাদের এবং পরিবেশের বিষয়টি সর্বজনীন এবং সেসব এলাকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সেখানকার শরণার্থীদের বাসস্থান পরিকল্পনা করতে হবে। সেখানকার বর্তমানে বিদ্যমান জীববৈচিত্র্য কোনোভাবেই ধ্বংস করা যাবে না। কারণ, পরিবেশ কোনো এলাকার নিজস্ব সম্পদ নয়, এটি বৈশ্বিক গুরুত্ব বহন করে থাকে।
লেখক : কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।