শিক্ষা
প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ হবে কবে?
দেশে যেন থামছেই না প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা। পিএসসি, জেএসসি, জেডিসি, এসএসসি, এইচএসসি, চাকরি বা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা—এমন কোনো পরীক্ষা নেই, যেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটছে না।
এরই ধারাবাহিকতায় ১ নভেম্বর থেকে সারা দেশে শুরু হওয়া জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পরীক্ষার আগেই পাওয়া যাচ্ছে ফেসবুক ও হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপে। এমনকি গত বুধবার (৯ নভেম্বর) অনুষ্ঠিত বিজ্ঞান বিষয়ের প্রশ্ন ফাঁসেরও খবর পাওয়া গেছে।
এর আগে ১ নভেম্বর বাংলা প্রথম পত্র, ২ নভেম্বর বাংলা দ্বিতীয় পত্র, ৫ নভেম্বর ইংরেজি প্রথম পত্র, ৬ নভেম্বর ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র, ৭ নভেম্বর ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা এবং অন্য ধর্ম, ৮ নভেম্বর বাংলা বিষয়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এর সব পরীক্ষারই প্রশ্নপত্র পরীক্ষার অন্তত এক ঘণ্টা আগেই পাওয়া গেছে।
গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানতে পারি, পরীক্ষার শুরুর দিন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার পর থেকেই ফেসবুকে শুরু হয় প্রশ্ন দেওয়ার প্রচারণা। একটি ফেসবুক আইডি থেকে স্ট্যাটাস দিয়ে দাবি করা হয়, তারা প্রতিটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পরীক্ষার আগের রাত থেকেই দিতে পারবে। আল্লাহর শপথ করেও দাবি করেন প্রশ্ন দেবেন। এ ছাড়া এমন আরো বেশ কিছু ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট থেকে স্ট্যাটাস দিয়ে প্রশ্ন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। আরেকটি ফেসবুক পেজ (পাবলিক) থেকে প্রায় প্রতিদিনই পরীক্ষার আগে পরীক্ষার প্রশ্ন আপলোড করা হচ্ছে। লিখিত সৃজনশীল ৭০ নম্বর ও এমসিকিউ ৩০ নম্বরের হুবহু মিল পাওয়া গেছে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সঙ্গে। এ ছাড়া ভিন্ন একটি ফেসবুক পেজ থেকেই প্রায় প্রতিটি জেএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন পরীক্ষার আগেই ফাঁস করা হচ্ছে। এ গ্রুপটি মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের কাছে প্রশ্নপত্র প্রদানের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
তবে শুধু জেডেসি বা জেএসসি নয়, সব ধরনের পাবলিক পরীক্ষায় আমরা প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা দেখতে পাচ্ছি। চলতি বছরে ঢাকা, জগন্নাথ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর পাওয়া গেছে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে পুলিশ আটকও করেছে।
এই যে একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে, সেটা মূলত ব্যাপকতা পেয়েছিল ২০১২ সালে। ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রাথমিকের সমাপনী পরীক্ষায়ও একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস ঘটতে থাকে। ২০১৪ সালে সমাপনী পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে ব্যাপকভাবে। ২০১৩ সালে সমাপনী পরীক্ষায় ইংরেজি ও বাংলা বিষয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা তদন্তে প্রমাণিত হয়। ইংরেজি ৮০ ও বাংলা ৫৩ শতাংশ প্রশ্ন মিলে যায় ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সঙ্গে। তবু এ পরীক্ষা বাতিল হয়নি। ২০১২ সালেও সমাপনী পরীক্ষায় বাংলা ও গণিতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে।
২০১৪ সালে সমাপনী পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ভ্রাম্যমাণ আদালত বিভিন্ন জেলায় দায়ীদের শাস্তি দিয়েছেন। প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে সোচ্চার অনেকে অনলাইনে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন প্রকাশ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। তাঁদের কাছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রমাণ রয়েছে।
কিন্তু তারপরও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া গেলেও এর পক্ষে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। ২০১৩ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায়ও সব প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। গণিত, ইংরেজি প্রথম পত্রসহ বিভিন্ন বিষয়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের হুবহু মিল পাওয়া যায়।
এ ছাড়া ২০১৩ সালে ৪ নভেম্বর থেকে শুরু হয় জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় ইংরেজি, গণিত, পদার্থ, রসায়ন, হিসাববিজ্ঞানসহ অন্যান্য বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।
২০১৩ সালের ৩১ মে ফাঁস হয়ে যায় অগ্রণী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সত্যতা পাওয়ার পর ১২ জুন ওই পরীক্ষা বাতিল করা হয়। ২০১০ সালের ৮ জানুয়ারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা হলেও পরীক্ষা বাতিল হয়নি।
২০১০ সালের ৮ জুলাই সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের সহকারী নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ায় পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। ২০১০ সালের ২৮ আগস্ট উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নিয়োগের লিখিত পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়। ২০১০-১১ সালে মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠে।
২০১১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় সিন্ডিকেট চক্র এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ২০১১ সালে অডিট বিভাগের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়। ২০১২ সালের ২৭ জানুয়ারি ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই খাদ্য অধিদপ্তরের নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়া হয়।
শেষ পর্যন্ত ওই পরীক্ষা বাতিল করা হয়। ২০১২ সালের ২৭ জুলাই জনতা ব্যাংকের নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পরীক্ষার আগের রাতে পুরান ঢাকার একটি হোটেল থেকে ফাঁস হওয়া প্রশ্নসহ ১৬ জনকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ২০১২ সালের ৩ আগস্ট জতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা পদে নিয়োগের বাছাই পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়।
ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সঙ্গে পরীক্ষায় হলের প্রশ্নের শতভাগ মিলে গেলেও ওই পরীক্ষা বাতিল বা তদন্ত হয়নি। ২০১২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই এটিরও প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়।ওই পরীক্ষার আগের রাতে এবং পরীক্ষার দিন সকালে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটে। ২০১২ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ৩৩তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষার সব কোর্সের প্রশ্ন ফাঁস হয়।
এ ঘটনায় ৬ অক্টোবর পিএসসি পরীক্ষা স্থগিত করে। ২০১২ সালের ২১ ও ২২ নভেম্বর শিশু শিক্ষার্থীদের জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা প্রাইমারি স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার (পিএসসি) গণিত ও বাংলা বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র ও রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হওয়ার প্রশ্নের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। ২০১৩ সালের ১২ অক্টোবর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসেরও অভিযোগ ওঠে।
মজার বিষয় হলো, প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার পর তদন্ত কমিটি হয়। কিন্তু তদন্ত আলোর মুখ দেখে না। কারা এই প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত, তা-ও থেকে যায় অজানা। প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে নানা রকম পদ্ধতি গ্রহণ করা হলেও ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। তাহলে এই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা বন্ধ হবে কবে?
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও প্রতিনিধি, বাংলাদেশ প্রতিদিন।