শিক্ষা
নার্সারির শিশু ও ট্রাভেল ব্যাগ
ভাগ্নিকে নিয়ে দোকানে গেলাম স্কুলের ব্যাগ কিনতে। সে ঘুরেফিরে বড় বড় ট্রাভেল ব্যাগের দিকে দৃষ্টি দেয়। জিজ্ঞেস করি, এত বড় ব্যাগ কেন? বলে, ‘মামা বোঝ না...আমার তো অনেক বই’। অনেক বই মানে এত বড় ব্যাগ? বললো হ্যাঁ...।
দিন কয়েক আগে দেশের একটি শীর্ষ দৈনিকের সংবাদে বলা হয়েছে, রাজধানীর কিন্ডারগার্টেনগুলোর নার্সারিতে ১০ থেকে ১৩টি বই পড়ানো হয়। প্রশ্ন হলো, মাত্র পাঁচ বছরের একটি শিশুকে যদি ১৩টি বই পড়তে হয়, তাহলে কখন সে ঘুমায়, কখন খায়, কখন খেলাধুলা করে?
ওই রিপোর্টে রাজধানীর মিরপুরের একটি কিন্ডারগার্টেনের নার্সারির পাঠ্যতালিকায় দেখা যাচ্ছে সোনামনিদের বাংলা পড়া, অক্সফোর্ড এবিসি, স্পন্দন গণিত শেখা, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, জেনারেল নলেজ, অক্সফোর্ড নার্সারি রাইমস, খোকাখুকুর প্রথম লেখা প্রথম শেখা, ইংরেজি হ্যান্ড রাইটিং, ছোটদের আরবি ও ইসলাম শেখা, ফুলকুঁড়িদের মজার ছড়া, চারুকারু ও ছবি আঁকা, আমার বই এবং এসো লিখতে শিখি বইগুলো পড়তে হয়। এর বাইরে রয়েছে ১০টি খাতা ও পেনসিল বক্স। পানির ফ্লাক্স ও টিফিন বক্স তো আছেই। এই খবরটি পড়তে পড়তে এটি সহজেই উপলব্ধি করতে পারি যে, আমার ভাগ্নি কেন রঙিন কার্টুনওয়ালা ছোট ব্যাগ দূরে ঠেলে বড়দের ট্রাভেল ব্যাগ কিনতে চায়।
স্মরণ করা যেতে পারে গত বছর উচ্চ আদালত একটি নির্দেশনা দিয়ে বলেছিলেন, প্রাথমিকের একজন শিশু তার শরীরের ১০ শতাংশের বেশি ওজনের ব্যাগ বহন করবে না। সেক্ষেত্রে পাঁচ বছর বয়সী একজন শিশুর শরীরের ওজন যদি হয় ২০ কেজি, তাহলে তার সর্বোচ্চ দুই কেজি ওজনের ব্যাগ বহন করার কথা। কিন্তু এখনো শিশুদের ট্রাভেল ব্যাগের মতো ভারি জিনিস ঘাড়ে বয়ে বেড়াতে হয় এবং কিন্ডারগার্টেনের সামনে দিয়ে যখন যাই, তখন তাদের ক্লান্ত মুখগুলো আমাদের কষ্ট দেয়।
প্রশ্ন হলো, কিন্ডারগার্টেনে শিশুদের এত পড়তে হবে কেন? একজন অভিভাবকের বরাত দিয়ে ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, নার্সারিতে যে ১৩টি বই পড়ানো হয়, তার মধ্যে দুটি বিনা মূল্যের সরকারি বই। মূলত এই দুটি বইয়ে যা আছে বাকি ১১টি বইয়ের বিষয়বস্তুও প্রায় একই। কিন্তু তারপরও কেন এই বাড়তি ১১টি বই? উত্তর সহজ; তা হলো––সরকারি প্রাথমিকের সাথে কিন্ডারগার্টেনের তফাৎ তৈরি করা। অনেক স্কুল নাকি প্রতিদ্বন্দ্বী স্কুলের সাথে পাল্লা দিয়ে পাঠ্যতালিকা তৈরি করে। ‘ভাবি, আর বইলেন না, আমার বাচ্চার তো ১০টা বই। তার উপরে ড্রংয়িং, নাচের ক্লাস আরো কত কী?...’ এই সংলাপগুলো কথিত অভিজাত স্কুলগুলোর সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেই শুনতে পারবেন।
মানে হলো, বাচ্চাদের পড়ালেখা এখন এক মস্তবড় ফ্যাশন। এখানে জ্ঞান অর্জনের চেয়ে বরং কার বাচ্চা কোন স্কুলে পড়ে, সেটিই মুখ্য। ‘অমুকের বাচ্চা অমুক স্কুলে চান্স পায় নাই’...এটা এখন সামাজিক আলোচনার বিশাল ইস্যু। কিংবা ‘এত বড়লোকের সন্তান সরকারি প্রাইমারিতে পড়বে, তা হয় নাকি?’...এসব সংলাপও আমাদের এলিট সমাজে জারি আছে। সুতরাং পাঁচ বছরের শিশু ১৩টা বই পড়ে, সেখানে কী পড়ে আর তা দিয়ে কী শেখে, তার চেয়ে বড় কথা সে কোথায় পড়ে? তার মাসিক বেতন কত? বছর বছর ভর্তি ফি, ডোনেশন––এ সবই মুখ্য।
পাঁচ বছরের একজন শিশুকে আধোঘুমে চোখ কচলাতে কচলাতে ঘুম থেকে উঠতে হয়। মেজাজ তিরিক্ষি। স্কুলে যেতে চায় না। পড়ালেখা তার কাছে এক আতঙ্কের নাম। এই করে করে শৈশবটাই মাটি হয়। ফলে আমরা যারা গ্রামে বা মফস্বলে সরকারি প্রাথমিক স্কুলে পড়ে, বনবাদাড়ে ঘুরে ঘুরে কিংবা জামরুল গাছের ডালে উঠে পুকুর ঝাঁপ দিয়ে বড় হয়েছি, তারা এখন এসব কথিত বড় স্কুলের বড় বড় পাঠ্যতালিকা দেখে বরং নিজেদের সৌভাগ্যবান বলেই মনে করি। কারণ, পড়ালেখার নামে আর যাই হোক, আমাদের শৈশব গলা টিপে হত্যা করেননি আমাদের মা-বাবা। যে আশঙ্কায় আছে আমার সন্তান। বছরখানেক পরই যাকে স্কুলে দিতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক