অভিমত
আমি শিক্ষামন্ত্রীকে সমর্থন করি
‘সহনীয় মাত্রায় ঘুষ খান’––শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের এই বক্তব্যে ফেসবুক তোলপাড়। রোববার তিনি শিক্ষা ভবনে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) সম্মেলন কক্ষে এক অনুষ্ঠানে কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেছেন, ডিআইএর কর্মকর্তারা ঘুষ নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে ভালো প্রতিবেদন জমা দেন। তিনি বলেন, ‘আপনারা ঘুষ খান, কিন্তু সহনীয় মাত্রায় খান।’
খবরটি গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হতে সময় লাগেনি। নানা মহল থেকেই শিক্ষামন্ত্রীকে আক্রমণ করে বক্তব্য ও তির্যক মন্তব্য আসছে এবং এটিই স্বাভাবিক। সরকারের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি, তাও আবার শিক্ষামন্ত্রীর মতো একজন সজ্জন লোক বলে পরিচিত মানুষের কাছ থেকে ঘুষের পক্ষে এমন সাফাই নিশ্চয়ই কারো কাম্য নয়।
তবে বাস্তবতার আলোকে মি. নাহিদের এই বক্তব্য পর্যালোচনার দাবি রাখে। তার আগে এই বক্তব্যের বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীর ব্যাখ্যাটাও আমাদের জানা দরকার। তিনি বলেছেন, ‘কর্মকর্তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে গিয়ে একসময় মাত্রাতিরিক্ত ঘুষ খেতেন। স্কুলে গেলেই খাম ধরিয়ে দিতেন। তখন থেকে তাঁদের হুঁশিয়ারি দিয়েছি, জিরো টলারেন্স নিয়েছি। আমরা তখন বলেছিলাম, ঘুষ খেলেও সহনশীল মাত্রায় নামিয়ে আনেন। কিন্তু এখন আমরা আরো কঠোর হয়েছি। তাদের ঘুষ খাওয়াসহ বিভিন্ন দুর্নীতির বিষয়ে জিরো টলারেন্স দেখাচ্ছি। এই কথাটিই আমি উদাহরণ হিসেবে বলেছি।’
কেউ ঘুষ খাবেন না, ঘুষ খেলে চাকরি চলে যাবে এবং ২০ বছর কারাদণ্ড––এ রকম বিধান সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা প্রত্যাশা করতেই পারি। কিন্তু তা যে হবে না, তা একজন অশিক্ষিত লোকও বোঝেন। কারণ, ঘুষ রাষ্ট্রের কোন স্তর থেকে কোন স্তরে বিস্তৃত, তা কারো অজানা নয়। একজন সরকারি অফিসের কর্মচারীর ৫০০ টাকা ঘুষ খাওয়া থেকে শুরু করে যে দেশে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ পাওয়ার জন্য শত শত কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন হয় এবং যে লেনদেনে রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের লোকেরাও জড়িত থাকেন, সেই দেশে সহনীয় মাত্রায় ঘুষ খাওয়ার কথা বলে শিক্ষামন্ত্রী অন্যায় কিছু বলেছেন বলে মনে হয় না।
ঘুষের পক্ষে এ রকম বক্তব্য আগেও আমরা পেয়েছি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের তরফে। তিনি এটাকে ঘুষ না বলে বরং ‘স্পিড মানি’ বলে উল্লেখ করেন। অর্থাৎ টাকা দিয়ে দ্রুত কাজ করানো। আমাদের বাস্তবতা এমনই যে, রাষ্ট্র যদি আইন করে ঘুষ বন্ধ করে ঘুষ গ্রহণের শাস্তি ২০ বছর কারাদণ্ডও করে, তারপরও ঘুষ বন্ধ হবে না। বরং ঘুষ না চাইলেও পাবলিক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ঘুষ দেবে নিজের কাজটা অন্যের আগে পাওয়ার জন্য। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশই নিয়ম মেনে, লাইনে দাঁড়িয়ে কাজ করতে অভ্যস্ত নয়। তারা যেকোনো কাজ লাইন ভেঙে অন্যের আগে দ্রুত করতে চায় এবং তারাই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ দেয়।
এই লেখাটি যাঁরা পড়ছেন, তাঁরা চিন্তা করে দেখুন জীবনের কোনো না কোনো সময়ে আপনিও বিশেষ সুবিধা পাওয়া বা নিজের কাজটি সম্পন্ন করার জন্য কোথাও না কোথাও, সেটা পাসপোর্টের পুলিশ ভেরিফিকেশন হোক আর বিদ্যুতের বিল কমানোই হোক––ঘুষ দিয়েছেন। কমবেশি ঘুষ/স্পিডমানি দেননি, এ রকম লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। পুলিশের কাছে কোনো কাজ থাকলে কিংবা গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি অফিসের কোনো কাজ ঘুষ ছাড়া কেউ করতে পেরেছেন, এমন সৌভাগ্যবানের সংখ্যা হাতেগোনা। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সম্ভবত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাই বিনা পয়সায় আগুন নেভান। আর কোনো প্রতিষ্ঠানের লোকেরা বিনা পয়সায় বা বিনা তদবিরে কাজ করেন বলে আমার বিশ্বাস হয় না।
সুতরাং শিক্ষামন্ত্রী সহনীয় মাত্রায় ঘুষ খাওয়ার কথা বলে নিজের যে অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেছেন, সেটিই নির্মম বাস্তবতা। কারণ তিনিও জানেন, ঘুষ একদিনে বন্ধ হবে না। বাংলাদেশে কোনোদিনই বন্ধ হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ থাকলেও যদি আসলেই এটা সহনীয় মাত্রায় আনা যায়, তাতেও মানুষের উপকার হয়।
সম্ভবত আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি ঘুষ লেনদেন ও লুটপাট হয় সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নে কর্মকাণ্ডে। যে রাস্তায় নির্মাণ ব্যয় সর্বোচ্চ ১০০ টাকা, সেটির বাজেট ধরা হয় ১২০ টাকা এবং কাজ হয় ৩০ টাকার। বাকি ৯০ টাকার ভাগবাটোয়ারা হয়। এখন শিক্ষামন্ত্রীর কথামতো যদি এই ১২০ টাকার মধ্যে ৮০ টাকার কাজ হয় এবং বাকি ৪০ টাকা ভাগবাটোয়ারা হয়, তাতেও রাস্তাটি বেশিদিন টেকসই হয়। মানুষ তাতেই খুশি। সাধারণ মানুষ কখনো ঠিকাদারের বাড়িতে গিয়ে রড-সিমেন্টের হিসাব চায় না। যাদের হিসাব চাওয়ার কথা, তারাও ওই ভাগবাটোয়ারার অংশ। ফলে ঘুষ যে পুরোপুরি বন্ধ হবে না, তা একজন ক্ষুদ্র চায়ের দোকানিও জানেন। সুতরাং মানুষের প্রত্যাশা হলো, রাস্তা, সেতু, কালভার্ট বা ফ্লাইওভারের মতো অবকাঠামোগুলো কার্যাদেশ অনুযায়ী হোক এবং সেখানে যদি টাকা-পয়সার লেনদেন হয়, হবে। তা নিয়ে আমজনতার খুব বেশি উদ্বেগ আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু কাজটা ঠিকমতো হোক।
চাকরি-বাকরির যে বেহাল দশা, যেভাবে লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার ঘুরছে, তাতে অনেকেই জমি-জমা বিক্রি করে, ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ঘুষের পয়সা জোগাড় করে। তো সেই তরুণ-তরুণী চাকরি পাওয়ার পরদিন থেকেই তো ওই ঘুষের টাকা পরিশোধের জন্য ঘুষ খাওয়া শুরু করবেন––এতে আর বিস্ময়ের কী আছে । যে লোক ১০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছে, এই টাকা বেতন পেতে তো তার ১০ বছর লাগবে। তাহলে সে খাবে কী? সুতরাং ঘুষই খাবে। কিন্তু এই খাওয়াটা যাতে সহনীয় মাত্রায় থাকে, যাতে গরিব মানুষকে গরু বা জায়গা-জমি বিক্রি করে ঘুষের পয়সা জোগাড় করতে না হয়, সে বিষয়ে যদি ঘুষখোররা একটু সচেতন থাকেন, অর্থাৎ গরিব মানুষের কথা যাতে সম্মানিত ঘুষখোররা একটু সদয় বিবেচনায় রাখেন, শিক্ষামন্ত্রী সেই অনুরোধটিই করেছেন। আমি তাঁকে সমর্থন করি।
লেখক : সাংবাদিক।