শহীদ বীরবিক্রম সিরাজুলের বীরত্বের গল্প
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে যেসব বীর সৈনিক মাতৃভূমি রক্ষায় অসামান্য নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন, বুকের রক্ত ঝরিয়ে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেন, তাঁদের মধ্যে একজন শহীদ সিরাজুল বীরবিক্রম।
কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজের তুখোড় ছাত্রনেতা সিরাজুল ইসলাম ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর দেশমাতৃকার টানে কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনার থানার গ্রাম ছিলানী হতে কয়েকজন যুবককে সঙ্গে নিয়ে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে।
যুদ্ধের শুরুতেই সিরাজুল ইসলাম সীমান্ত অতিক্রম করে আসামের ইকোয়ান ক্যাম্পে ৩২ দিন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি ৫ নম্বর সেক্টরে বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন রণাঙ্গণে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। একাত্তরের ৮ নভেম্বর অসম সাহসী যোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম পাকহানাদার বাহিনীর শক্তিশালী দুর্গকে ভেঙে জয়ের আনন্দে যখন আত্মহারা, তখনই পিছু হটা হানাদারদের গুলিতে শহীদ হন টগবগে এই যুবক। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পাকহানাদার বাহিনীর সঙ্গে সুনামগঞ্জের সাচনা যুদ্ধ একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
সেটি ছিল ১৯৭১ সালের ৮ আগস্টে ঘটনা। জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে মেজর বাট ময়মনসিংহের চৌকস ৩৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে অগ্রগামী দল (অ্যাডভান্সড পার্টি) গঠন করেন। এ দলের কমান্ডার নিযুক্ত হন সিরাজুল ইসলাম। অগ্রগামী দলের ওপর আদেশ হয়, ঢাকা-সিলেট নৌপথে তৎকালীন সুনামগঞ্জ মহকুমার গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর ‘সাচনা বাজার’ শত্রুমুক্ত করার। ঢাকা-সিলেট সড়কের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু সিরাজের দল উড়িয়ে দেওয়ায় নদীপথে সাচনার মাধ্যমেই পাকবাহিনী সিলেটের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করত। এ অবস্থায় সিরাজের নেতৃত্বাধীন অগ্রগামী দলের ওপর সাচনা মুক্ত করার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পড়ে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে সিরাজের নেতৃত্বে দলটি দুটি ছিপ নৌকায় সাচনার ২৫ মাইল উত্তর দিক থেকে অভিযান শুরু করে।
শ্রাবণের মেঘে আচ্ছাদিত হালকা বৃষ্টির মধ্যে মেজর বাট, ক্যাপ্টেন বিজয় শর্মাসহ অন্যরা অনাড়ম্বরভাবে দলটিকে বিদায় জানান। অত্যাধুনিক অস্ত্রসজ্জিত পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁদের অস্ত্র বলতে ছিল হালকা থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল আর গ্রেনেড। দীর্ঘ তরঙ্গ পাড়ি দিয়ে গভীর রাতে দলটি সাচনার উপকণ্ঠে পৌঁছে আঁটসাঁট করে মাথায় গামছা বেঁধে কমান্ডার সিরাজের সঙ্গে অন্যরা দীপ্তকণ্ঠে শপথবাক্য উচ্চারণ করেন, ‘মন্ত্রের সাধন, না হয় শরীর পতন।’ ঠিক এ সময় পাকবাহিনী দৈবাৎ ঘটনা আঁচ করে সচকিত হয়ে পড়ে। তারা সুরক্ষিত বাঙ্কারে অবস্থান নেয় এবং অগ্রগামী দলের ওপর বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু করে। ঘটনার আকস্মিকতায় মুক্তিযোদ্ধারা কিছুটা বিব্রত হলেও কমান্ডার সিরাজ পাল্টা আক্রমণের আদেশ দেন। শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ।
পাকবাহিনী মেশিনগানের সাহায্যে বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করে চললেও সিরাজের বাহিনী সামনে এগিয়ে চললে পাকহানাদার ও অগ্রগামী দলের দূরত্ব দাঁড়ায় মাত্র ১০০ গজের মধ্যে। সিরাজ বারবার ‘আগাও’, ‘আগাও’ বলে চিৎকার করে তাঁর বাহিনীকে বিপুল বিক্রমে শত্রুশিবিরের আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে চলেন। একপর্যায়ে যুদ্ধকে প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে নিয়ে আসেন। দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে ৩৬ পাকসেনা নিহত হয়। শত্রুর প্রতিরোধ সম্পূর্ণ ভেঙে পড়লে তারা পালানোর প্রক্রিয়া শুরু করে। ঠিক সেই মুহূর্তে যুদ্ধজয়ী সিরাজ আনন্দে আত্মহারা হয়ে নিজ অবস্থান ছেড়ে লাফিয়ে ওঠেন এবং স্বাধীনতার স্লোগান দিতে শুরু করেন। এ সময় ঘটে যায় সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা। পলায়নরত শত্রুর ‘কাভারিং ফায়ারের’ একটি বুলেট এসে লাগে সিরাজের চোখে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। আহত সিরাজকে চিকিৎসার জন্য মিত্রবাহিনীর হেলিকপ্টারে ভারত নেওয়ার সময় পথে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
তাঁর মরদেহ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের নো ম্যানস ল্যান্ডের নিকটবর্তী টেকেরঘাটে অবতরণ করানো হয়। সেখানে সন্ধ্যায় খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে পূর্ণ সামরিক মযাদায় দাফন করা হয়। তাঁর গুলিবিদ্ধ হওয়ার স্থানটিকে স্থায়ীভাবে চিহ্নিত করে রাখা হয়।
স্বাধীনতার পর সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের উপস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার বিশাল সমাবেশে সাচনার নামকরণ করা হয় ‘সিরাজনগর’। বঙ্গবন্ধু সরকার সিরাজকে অসামান্য বীরত্বের জন্য ‘বীরবিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করেন।
মৃত্যুর মাত্র নয় দিন আগে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদ সিরাজ তাঁর বাবার কাছে লিখেছিলেন সর্বশেষ চিঠি। সেই চিঠির প্রতিটি কথায় ফুটে উঠেছে দেশপ্রেমের অপূর্ব নিদর্শন, রাজাকারদের ক্ষমা না করার আকুলতা। একাত্তরের চিঠি বইতে সিরাজের লেখা চিঠিটি স্থান পেয়েছে।
বাংলার এই বীরসন্তান ১৯৫২ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলার এলংজুরি ইউনিয়নের ফিলনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম মকতুল হোসেন এবং মায়ের নাম গফুরন নেছা। সিরাজুল ইসলাম ১৯৭১ সালে স্নাতক শ্রেণির ছাত্র ছিলেন।
তথ্যসূত্র:
১. নরসুন্দা/ মানুষ-সমাজ/ ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬
২. তোমাদের এ ঝণ শোধ হবে না/ প্রথম আলো/ ৫ নভেম্বর ২০১২
৩. সিরাজুল ইসলামের শাহাদাতবার্ষিকী/ দৈনিক জনকণ্ঠ
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও প্রতিনিধি, বাংলাদেশ প্রতিদিন।