অভিমত
কার শিক্ষা, কে নেবে?
দুর্নীতির দায়ে দেশের ইতিহাসে প্রথম কোনো সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাজা হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা বলছে আইনের শাসন। যার সাজা হয়েছে তার দল বলছে প্রতিহিংসা।
কিন্তু যারা ক্ষমতায় নেই বা সরাসরি কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন, সেই সাধারণ মানুষ যেমন নির্দলীয় শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, বাসের কন্ডাকটর, দিনমজুর কিংবা ভবঘুরে––তারা কী ভাবছেন? তাদের কাছে একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে দুর্নীতির দায়ে পাঁচ বছরের জেল দেওয়ার এই ঘটনাটি কতটা আইনের শাসন আর কতটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা––সেই জবাব কি রাজনীতিকরা কোনোদিন জানবেন?
বৃহস্পতিবার দুপুরে বিএনপি চেয়ারপারসনসহ মোট ছয় জনের বিরুদ্ধে রাজধানীর বকশীবাজারে স্থাপিত অস্থায়ী বিশেষ জজ আদালতের রায়ের পরে নয়াপল্টনে দলীয় কার্যলয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব দাবি করেছেন, জনগণ এই রায় ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রশ্ন হলো, তিনি কী করে জনগণের এই অভিব্যক্তি জানলেন? নাকি তিনি মনে করেন যে, তারা যেটিকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন, জনগণও তাই করে? পক্ষান্তরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতারা যে এই রায়কে আইনের শাসনের একটি বড় উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছেন, সেটিও কি জনগণ বিনা বাক্যে মেনে নিয়েছে?
দুর্নীতির দায়ে খালেদা জিয়াকে সাজা দেওয়া এবং কারাগারে পাঠানোর ঘটনাটির রাজনৈতিক তাৎপর্তা অনেক। বিশেষ করে আগামী জাতীয় নির্বাচনের সকল সমীকরণ পাল্টে দেওয়ার জন্য এই রায়টিই যথেষ্ট।যদি শেষমেষ বেগম জিয়া নির্বাচনে অযোগ্য হয়ে যান এবং বিএনপি যদি ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো একাদশ জাতীয় নির্বাচনও বর্জন করে, তাহলে আরো একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন থেকে দেশের মানুষ বঞ্চিত হবে এবং দেখা যাবে এই নির্বাচনেও অনেক প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হবেন, যেটি সামগ্রিকভাবে দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার পথে আরেকটি ক্ষতের সৃষ্টি করবে।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এই মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে।একই সময়ে দুর্নীতি দমন কমিশন আরো যেসব রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে (বর্তমান প্রধানমন্ত্রীসহ)মামলা করেছিল, সেগুলো খারিজ হয়ে গেছে। কিন্তু বেগম জিয়ার মামলাটি চলেছে এবং অবশেষে তার সাজাও হয়েছে। বিচারক সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে রায় দেন এ কথা যেমন সত্যি, তেমনি আমাদের দেশের বিচারব্যবস্থায় সরকারের যে কী প্রভাব থাকে (যেকোনো সরকারের আমলে) তা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। সুতরাং খালেদা জিয়ার এই রায়ের মধ্য দিয়ে দুর্নীতির মামলায় সাবেক সরকার প্রধানের সাজা দেওয়ার যে ‘সংস্কৃতি’ চালু হলো, ভবিষ্যতেও এটি অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা করা যায়।
যদি এই রায়ের মর্মবাণী এই হয় যে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়, তাহলে প্রশ্ন উঠবে, আরো যেসব রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আছে, তাদের সবার বিচার হবে? ব্যাংকিং খাত থেকে যে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হলো, তার বিচার হবে? ফারমার্স ও জনতা ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির পেছনে খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন অধ্যাপকেরও নাম এসেছে। দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠের দুজন সম্মানিত অধ্যাপক, যাদের নাম শুনলে আমাদের মাথা নত হয়ে আসে, সেই মানুষগুলোর বিরুদ্ধে অর্থ লোপাটের যে অভিযোগ উঠেছে তার সঠিক তদন্ত এবং তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের কত বছরের কারাদণ্ড হবে? ‘সরকারি বিরোধী দল’ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের বিরুদ্ধে মঞ্জুর হত্যা মামলা কি তার জীবদ্দশায় শেষ হবে? এসব প্রশ্নও এখন হয়তো সামনে আসবে।
আমাদের দেশে রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলার একটা বড় সমস্যা এর রাজনীতিকরণ।অর্থাৎ যখনই কোনো রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়, সেটি হোক দুর্নীতির, হোক নাশকতার, যুদ্ধাপরাধ কিংবা ঋণখেলাপির––সব মামলাকেই বলা হয় ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’। ফলে সত্যিকারের অপরাধও অনেক সময় আড়াল হয়ে যায়। আবার সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশই এগুলোকে রাজনৈতিক মামলা বলে বিশ্বাস করে। এর দ্বারা রাজনীতিবিদরা মূলত একটা বিশেষ সুবিধা পান। তা ছাড়া এসব মামলার বিচার করতে গিয়ে বিচারক এবং বিচার সংশ্লিষ্টরাও বেশ বেকায়দায় পড়েন।
খালেদা জিয়ার মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণার পর থেকেই প্রধান দুটি দলের নেতারা যে ভাষায় এর প্রতিক্রিয়া জানানো শুরু করেছিলেন, সেটি যেকোনো অর্থেই আদালতের ওপর চাপ তৈরি করেছে। মামলার মেরিট যাই হোক, এই মামলায় বেগম জিয়ার সাজা হওয়ায় বিএনপির জোর গলায় বলছে তারা ন্যায়বিচার পায়নি। পক্ষান্তরে সরকারের তরফে বলা হচ্ছে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ রকম পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের সবচেয়ে বড় ভিকটিম হয় দেশের বিচার বিভাগ ও আইনের শাসন।
এতকিছুর পরও খালেদা জিয়ার এই রায় নিঃসন্দেহে রাজনীতিবিদদের জন্য একটি বড় বার্তা যে, দুর্নীতি যত টাকার হোক, যে আমলেরই হোক––একদিন এর বিচার হতেই পারে। ক্ষমতায় থাকতে তারা যেভাবে নিজেদেরকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে মনে করেন, সেই মনে করাটা যে আপেক্ষিক, বেগম জিয়ার এই রায় অন্তত সেই চিরায়ত ধারণায় একটা বড় কষাঘাত। তিনি উচ্চ আাদলতে যাবেন, সেখানে কী রায় হবে, তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি না, তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু যে কারণে এই মামলা এবং এর রায়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো,এই রায়ের মধ্য দিয়ে এটি অন্তত প্রমাণিত হয়েছে যে, ক্ষমতায় থাকতে ধরাকে সরা জ্ঞান করলে একদিন না একদিন এর মূল্য দিতেই হয়। এটা সব দলের, সব রাজনীতিবিদের জন্যই প্রযোজ্য।
লেখক : সাংবাদিক