ভ্যাট প্রত্যাহার
অর্থমন্ত্রীকে বিলম্বিত ধন্যবাদ
জুন মাসে বাজেট পাস হয়েছে, সে বাজেটেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও প্রকৌশল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর ভ্যাট আরোপ করা হয়। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় ১০ শতাংশ হারে এসব শিক্ষার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যালু এডেড ট্যাক্স-ভ্যাট) নির্ধারণ করেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এ হার কমিয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়। এতে দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টির সুযোগ না দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। সরকার কোনোমতেই শিক্ষাঙ্গনে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে চায় না এবং জনজীবনে অসুবিধাও সৃষ্টি করতে চায় না, সেই দৃষ্টিতে বিবেচনা করেই ভ্যাট প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এমনটিই বলা হয়েছে ভ্যাট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে।
গত ৯ সেপ্টেম্বর ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মাঠে নামেন। পুলিশি অ্যাকশন হলো তাঁদের ওপর। পরদিন পুরো রাজধানীই অচল করে দিল শিক্ষার্থীরা। তবে অহিংস আন্দোলন, দাবিটাও যৌক্তিক। রোববার চলল, সোমবারও আন্দোলন চলছিল। সোমবার পূর্বনির্ধারিত মন্ত্রিপরিদের সভা। সেই সভাতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থমন্ত্রীকে এ ভ্যাট প্রত্যাহারের জন্য নির্দেশ দেন। এরপরই আসে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ভ্যাট প্রত্যাহারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা।
ভ্যাট থেকে সরকারের আয় কত হতো, তার কোনো নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। তবে দৈনিক প্রথম আলোর তথ্যমতে, শিক্ষার্থীদের থেকে ভ্যাট আদায় হতো ৫০ কোটি। বিবিসি বাংলা বলছে, আড়াইশ থেকে তিনশ কোটি টাকা। আর বাংলা বিজনেস ডেইলি বণিক বার্তা ইউজিসির তথ্য হিসাব করে দেখিয়েছে আয় হতো সর্বোচ্চ ২০০ কোটি টাকা।
এখন প্রশ্ন হলো, এ ৩০০ কোটি টাকা আয় কি সরকারে জন্য খুবই জরুরি ছিল? না হলে কেন অর্থমন্ত্রী গত কয়েকদিন দফায় দফায় ভ্যাট আরোপের বিষয়টি উল্লেখ করলেন এবং নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন? যদিও ভ্যাট শিক্ষার্থীরা না, বিশ্ববিদ্যালয় দেবে এমন সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।
গেল শনিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী বলেন, এবারের বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর যে সাড়ে সাত শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে, সেটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই দেবে। ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি অনুরোধ করেন তারা যেন সতর্ক থাকেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যাতে ভবিষ্যতে এই ভ্যাটের অজুহাত দেখিয়ে নতুন করে টিউশন ফি বা অন্য কোনো নামে বাড়তি অর্থ নিতে না পারে। এ জন্য আন্দোলন করার পরামর্শও দেন তিনি।
এর আগে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ‘আমি একটি হিসাব করে দেখেছি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর প্রতিদিন খরচ হয় এক হাজার টাকা। এটা তার ফি, বইয়ের খরচ, লাইব্রেরি ফি, খাওয়া-দাওয়াসহ। আমি সেখান থেকে কত চেয়েছি? মাত্র ৭৫ টাকা।’
যদিও এনবিআর দুই দফায় জানিয়েছে, টিউশন ফির ওপর এই ভ্যাট আলাদা করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা হবে না বরং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সরকারকে এই ভ্যাট পরিশোধ করবে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় মালিকদের সংগঠনও ঘোষণা দেয়, বিশ্ববিদ্যালয় ভ্যাট দিতে পারবে না। এর দায় শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীর ওপরই পড়বে। পাশাপাশি তাঁদের দাবি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে। আর কোনো ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠানের ওপর ভ্যাট আরোপ হয় না বলে দাবি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এক হাজার টাকা খরচের হিসাবটি কীভাবে কষলেন অর্থমন্ত্রী? দৈনিক ১০০ টাকায় চলেন এমন শিক্ষার্থীও আছে দেশে। মাননীয় মন্ত্রীর হিসাব থেকে কি বাদ পড়ে গেছেন তারা? অর্থমন্ত্রী কি জেনেবুঝেই বেসরকারি উচ্চশিক্ষার ওপর ভ্যাট আরোপ করেছিলেন। শিক্ষা যে মৌলিক অধিকারের একটি, এটা কি তিনি ভুলতে বসেছিলেন? না হলে ওনাকে বারবার কেন এটার পক্ষে অবস্থান নিতে হলো? নাকি সরকারের বুঝতেও পাঁচদিন সময় লাগল, যে ভ্যাট আরোপ ঠিক হয়নি? এরপর প্রত্যাহার করা হলো। আবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকদের দাবিটির বিবেচনাও নেওয়ার মতো। ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠানের ওপর ভ্যাট আরোপ করা না গেলে তো যে বাজেট পাস হয়েছে, তাতেই গরমিল হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
দেশে মোবাইল টেলিকম, ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো ও বড় করপোরেটদের কাছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পাওনা রয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। আয়কর দেন না, এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। এর বাইরে এখনো অনেক খাত রয়েছে, যাতে ভ্যাট আরোপ করা যেতে পারে। আমরা দেশ হিসেবে এখনো শিক্ষায় এত ওপরে উঠতে পারিনি। এরপরও কেন ভ্যাট আরোপ করে শিক্ষার বিস্তার রোধ করা হবে। আবারও এ খাতকে দমিয়ে দিতে নতুন করে কেই কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না, এটাই কাম্য। বাজেট পাসের তিন মাস পর শিক্ষার্থীরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে, সরকারও পাঁচদিন পর এতে সাড়া দিয়েছেন। অর্থমন্ত্রী দেরিতে হলেও আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে ভ্যাট প্রত্যাহার করে নিয়েছেন, এজন্য তাঁকে বিলম্বিত ধন্যবাদ।
লেখক : প্রতিবেদক, দৈনিক বণিক বার্তা।