রোহিঙ্গা সংকট
বাংলাদেশ আর কত দিন সহ্য করবে?
রোহিঙ্গা সংকটের ‘ইনোনেস্ট ভিকটিম’ বা ‘নিষ্পাপ শিকার’ দেশটির নাম বাংলাদেশ—প্রায় চার দশক ধরে যাকে এই বোঝা বইতে হচ্ছে; অথচ যে সংকটের দায় কোনোভাবেই তার নয়।
বিশ্ব জনমত, জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো শক্তিশালী গোষ্ঠীও আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশের পক্ষে এবং রোহিঙ্গা নিধনকারী দেশ মিয়ানমারের বিপক্ষে থাকা সত্ত্বেও এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চুক্তি হওয়ার পরও এখন অবধি একশ রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। আদৌ হবে কি না বা হলেও শেষমেশ আসলে দশ-এগারো লাখ রোহিঙ্গার মধ্য থেকে কতজনকে পাঠানো সম্ভব হবে কিংবা কতজন যেতে রাজি হবেন—তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ চুক্তিতে বলা হয়েছে, যারা স্বেচ্ছায় যেতে চায়, কেবল তাদেরই ফেরত নেবে মিয়ানমার। প্রশ্ন হলো, তারা স্বেচ্ছায় এমন একটি ভূখণ্ডে কেন যেতে চাইবে, যেখানে তাদের জন্য মৃত্যুর বিভীষিকা ছাড়া কিছুই আর অবশিষ্ট নেই? তাহলে কি সচেতনভাবে সেই চুক্তি বা সমঝোতার ভেতরে গলদ রাখা হয়েছে?
একদিকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে দ্বিপক্ষীয় এবং আন্তর্জাতিক তৎপরতা, অন্যদিকে ভাসানচরে তাদের জন্য আবসস্থল নির্মাণ; রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন দেশের সহায়তার ঘোষণাও এই সংকটকে প্রলম্বিত করারই নামান্তর বলে মনে হয়। তার মানে কি এই সংকট পুঁজি করে কেউ কেউ রাজনৈতিক এবং অন্যান্য সুবিধা নেওয়ার ধান্দায় ব্যস্ত?
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিতাড়ন শুরু হয় বহু আগে থেকেই। কিন্তু সর্বশেষ গত বছরের ২৫ আগস্ট সেখানে মিয়ানমার সেনাবাহিনী গণহত্যা এবং জাতিগত নিধন শুরু করলে প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ মানুষ নাফ নদী পার হয়ে ঢুকে পড়ে বাংলাদেশ সীমান্তে। মানবিক কারণে সেই বিপুলসংখ্যক মানুষকে আশ্রয় দেয় বাংলাদেশ। এ সময় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষের শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয়প্রার্থী হওয়ার স্মৃতিও মনে করিয়ে দেন আমাদের রাজনীতিকরা। কিন্তু সমস্যা হলো, সেই মানবিকতা আর মহানুভবতার নির্মম শিকার হয়েছে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের প্রাণ-প্রকৃতি; স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা; বন-পাহাড় ও বন্যপ্রাণী। রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা এই বিপুল জনগোষ্ঠীর চাপ সইতে না পেরে এরই মধ্যে পরিবেশ বিপর্যয়ের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ওই সব এলাকায়। অনেক রোহিঙ্গা দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশি পাসপোর্ট করে বিদেশে চলে গেছে বলে স্বীকার করেছেন খোদ প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী। এক অর্থে এটি ইতিবাচক। কেননা, এভাবে যদি তারা বাংলাদেশে ছেড়ে যায়, সেটি আমাদের জন্য মন্দ নয়। কিন্তু সমস্যা হলো, রোহিঙ্গারা অন্য দেশে যাচ্ছে বাংলাদেশের পাসপোর্টে এবং সেখানে গিয়ে কোনো অন্যায়-অপরাধে জড়ালে তার দায় এসে পড়ছে বাংলাদেশের ওপর। আবার তারা তৃতীয় কোনো দেশে গিয়ে যে আয় করছে, সেই টাকা পাঠাচ্ছে মিয়ানমারে তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে। সব মিলিয়ে রোহিঙ্গা সংকট এখন বাংলাদেশের জন্য তৈরি করেছে বহুমাত্রিক সমস্যা—যার আশু সমাধানের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।
গত এক বছরে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে কেবল রাখাইনে নিধনযজ্ঞ কমলেও সামগ্রিকভাবে এই সংকট সমাধানের কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি। আবার সেখানে নিধনের শিকার হয়ে সম্ভবত দুই-তৃতীয়াংশ রোহিঙ্গা মুসলমানই পালিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছে। বাকিরাও নানাবিধ চাপ সইতে না পেরে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ বা অন্য কোথাও পাড়ি দেবে এবং একসময় পুরো রাখাইন রোহিঙ্গামুক্ত হবে—যেটিই মূলত চায় মিয়ানমার সরকার এবং সে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ; যারা ‘এক দেশ এক জাতি’ তত্ত্বে বিশ্বাস করে—যে কারণে শুধু সেখানে রোহিঙ্গা মুসলমানই নয়, বরং সংখ্যালঘু অন্যান্য জনগোষ্ঠীর ওপরেই ‘সিস্টেমেটিক কিলিং’ বা ‘পদ্ধতিগত হত্যাযজ্ঞ’ চালানো হয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে এসব তথ্য এখন বিশ্ববাসীর জানা।
এ বিষয়ে এখন আর দ্বিমত পোষণের সুযোগ নেই যে, বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার মোটেই আগ্রহী নয়। তারা চায় শুধু সময়ক্ষেপণ করতে। আবার সে দেশের সরকারের অভ্যন্তরে সেনাবাহিনীর যে বিপুল প্রভাব—তাতে শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চির দলের নেতৃত্বে কথিত গণতান্ত্রিক সরকার দেশটির রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকলেও আখেরে তারা সেনাবাহিনীর পুতুল বৈ কিছু নয়। ফলে রোহিঙ্গা সংকটের রাজনৈতিক বা বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় সমাধানও সুদূরপরাহত। জাতিসংঘ বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো গোষ্ঠী মধ্যস্থতা করলেও এসবকে যে মিয়ানমার খুব একটা পাত্তা দেয় না, তা এরই মধ্যে নানা ঘটনায় প্রমাণিত।
দ্বিতীয়ত এ বিষয়টিও এখন পরিষ্কার যে রোহিঙ্গা সংকট শুধু তাদের জন্য নিরাপত্তা সমস্যা নয়; বরং এটি রাজনৈতিক সমস্যা। মিয়ানমারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকরা সিদ্ধান্ত নিয়েই তাদের দেশকে রোহিঙ্গামুক্ত করার মিশন বাস্তবায়ন করছে। অর্থাৎ সমস্যাটা যেহেতু রাজনৈতিক, সুতরাং এর সমাধানও রাজনীতিবিদদের হাতে। কিন্তু মিয়ানমার তো রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। সেটিও আরেক পাকিস্তান—যে দেশ সম্পর্কে বলা হয়, ‘পৃথিবীর সব দেশের সেনাবাহিনী আছে, কিন্তু সেনাবাহিনীর একটি দেশ আছে, যার নাম পাকিস্তান।’ সম্ভবত মিয়ানমার সম্পর্কেও ঠিক একই কথা বলা যায়।
সুতরাং রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান যে শুধু কূটনৈতিক তৎপরতায় হবে না, তা এরই মধ্যে নিশ্চয়ই বাংলাদেশ সরকারও বুঝে গেছে। কারণ, কূটনীতি হচ্ছে রাজনীতিরই একটি অংশ। কিন্তু যে দেশে রাজনীতিবিদদের ওই অর্থে কোনো গুরুত্ব নেই—সে দেশের কূটনীতিক কিংবা মন্ত্রী-আমলারা রোহিঙ্গা সংকটের কোনো সমাধানই দিতে পারবেন না, যতক্ষণ না সে দেশের সেনাবাহিনী এ বিষয়ে একমত হয় এবং সে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে ভিন্ন জাতিসত্তা এবং বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধা তৈরি হয়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীও তো সে দেশের জনগণেরই অংশ। এটি একার্থে সঠিক। কিন্তু এখানে সমস্যাটা আরো গভীর। সভ্য রাষ্ট্রে যেমন সেনাবাহিনী সরকারের অংশ এবং সরকারের অধীন থাকে—মিয়ানমার ও পাকিস্তানে বিষয়টা উল্টো। ফলে মাসের পর মাস রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দ্বিপক্ষীয় এবং আন্তর্জাতিক নানা তৎপরতা চললেও তার ন্যূনতম কোনো ফল দৃশ্যমান নয়। আবার রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর এই আলাপচারিতার ফাঁকে এই জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা, ধর্ষণের মতো যে আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘঠিত হয়েছে—তার বিচারের দাবিটিও আমাদের জারি রাখতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক।