অভিমত
রাজনীতির খেলা ও রেফারিং
নির্বাচন হচ্ছে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক খেলা, যেখানে নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষভাবে রেফারিং করতে হয়। খেলোয়াড়টি যত শক্তিশালী, অর্থাৎ তার গায়ে যে দলের জার্সিই থাকুক না কেন, ফাউল করলে তাকে হলুদ এবং প্রয়োজনে লাল কার্ড দেখানো রেফারির (নির্বাচন কমিশন) দায়িত্ব। যদি রেফারি এই দায়িত্বটি সুচারুরূপে পালনে ব্যর্থ হন, তখন খেলায় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সবার জন্য সমান সুযোগ থাকে না। সবার জন্য সমান সুযোগ না থাকার অর্থই হলো বিশেষ কেউ সুবিধা পাচ্ছে। বিশেষ কারো সুবিধা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
রাজনীতির সবচেয়ে বড় খেলা, অর্থাৎ নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা তথা ব্যক্তি ও দল নির্বিশেষে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিতে গণমাধ্যমেরও একটি বড় দায়িত্ব আছে। কেননা, কোন প্রার্থী কোথায় কীভাবে অন্যের সুযোগ নষ্ট করছেন বা ফাউল করছেন, সেটি গণমাধ্যমের ক্যামেরাই প্রথম ধরা পড়ে। কিন্তু গণমাধ্যম সেই ছবি কতটা দেখাতে পারছে—তার ওপরেই মূলত নির্ভর করে খেলাটি কতটা উপভোগ্য হবে কিংবা কতটা একপেশে।
নির্বাচনের তিনটি পর্যায়েই (নির্বাচন-পূর্ববর্তী, নির্বাচনকালীন ও নির্বাচন-পরবর্তী) রেফারি এবং ওয়াচডগ, অর্থাৎ গণমাধ্যমের নজরদারির বিষয় রয়েছে। অর্থাৎ কারা প্রার্থী হলেন, কী তাঁদের যোগ্যতা, তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পদের বিবরণ, শিক্ষাদীক্ষা, মামলাসহ আটটি তথ্য হলফনামায় দিতে হয় বলে এসব পর্যালোচনা করে সহজেই ভোটারদের সামনে এটি তুলে ধরা সম্ভব যে, কারা প্রার্থী হলেন। কিন্তু এখানে সমস্যা হলো, সবাই এই হলফনামায় সঠিক তথ্য দেন না। অনেকে তথ্য গোপন করেন। অনেকে নিজের সম্পত্তি স্ত্রী বা সন্তানদের নামে দেখান। কেউ কেউ শিক্ষাগত যোগ্যতা, ঋণখেলাপ এবং ফৌজদারি মামলার তথ্যও অনেক সময় গোপন করেন। রেফারি (ইসি) এবং ওয়াচডগের (গণমাধ্যম) দায়িত্ব, এই হলফনামা বিশ্লেষণ করে মানুষের সামনে সঠিক চিত্র তুলে ধরা। কেউ যদি তথ্য গোপন করেন, সেটিরও অনুসন্ধান করা। এর মাধ্যমে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগে নাগরিকদের সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে যে, তাঁরা কাকে এবং কাদের তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে জাতীয় সংসদে পাঠাবেন। সেইসঙ্গে তা২রা অতীতে কী করেছেন, আগে যদি এমপি হয়ে থাকেন বা বর্তমানেও এমপি হন, তাহলে ভোটারদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কতটা বাস্তবায়ন করেছেন এবং গত পাঁচ বছরে তার সম্পদ কত শতাংশ বেড়েছে—সেটি অনুসন্ধান করে সঠিক তথ্য মানুষের সামনে তুলে ধরাও গণমাধ্যমের দায়িত্ব।
অধিকাংশ প্রার্থীই নির্বাচনী খরচের নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করেন এবং কেউ কেউ নির্ধারিত সীমার ১০ গুণ বেশিও খরচ করেন। ফলে সাংবাদিকদের এটি একটি বড় অনুসন্ধানের জায়গা। দেখা যায়, অনেক প্রার্থী তার জন্য নির্ধারিত বাজেটের পুরোটাই খরচ করেন পোস্টার ও লিফলেট তৈরিতে। তাহলে বাকি অর্থ কোথা থেকে আসে বা কোথায় কোথায় খরচ হয়? এ ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা বিভিন্ন প্রেসে গিয়ে অনুসন্ধান চালাতে পারেন যে, কোন প্রার্থী কত লাখ টাকার পোস্টার ও লিফলেট ছাপালেন। এর বাইরে বিভিন্ন পথসভাসহ নানা খাতে যে খরচ করেন, তার পুরোটাই একটি নির্ধারিত ব্যাংক হিসাব থেকে খরচ করার কথা। কিন্তু অধিকাংশ প্রার্থীই এই নিয়ম ভঙ্গ করেন। এসবের বিরুদ্ধে রিটার্নিং কর্মকর্তা কী ব্যবস্থা নিলেন বা আদৌ নিলেন কি না—সেটিও অনেক বড় রিপোর্টের বিষয় হতে পারে।
ভোটের আগে এবং নির্বাচনকালীন প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকদের আচরণবিধি লঙ্ঘন একটি সাধারণ ঘটনা। কিন্তু যখন কোনো হেভিওয়েট প্রার্থী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেন, তখন রিটার্নিং কর্মকর্তার পক্ষে অনেক সময় এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি কোনো নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে না হয়, তখন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা ভোটের মাঠে বাড়তি সুবিধা ভোগ করেন এবং রিটার্নিং কর্মকর্তা যদি সৎ ও সাহসী না হন, তখন তিনি অনেক কিছুই দেখেও না দেখান ভান করেন। এ রকম পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমকে ওই হেভিওয়েট প্রার্থীর আচরণবিধি লঙ্ঘন এবং রিটার্নিং কমিশনের নির্লিপ্ততার বিষয়ে সংবাদ ও বিশ্লেষণ প্রকাশ করতে হয়। এতে অবশ্য গণমাধ্যমের জন্য কিছু ঝুঁকিও তৈরি হয়।
একটি জাতীয় নির্বাচনে সরকারের ৬০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা খরচ হয়। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই খরচ হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পেছনে এবং বাকি একাংশ নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায়। এই বিশাল অঙ্কের টাকা কোথায়-কীভাবে খরচ হলো, তার জবাবদিহি কী, এই অর্থ খরচের সঠিক অডিট হয় কি না, অডিট আপত্তি এসেছে কি না, এলে সে বিষয়ে সংসদের সরকারি হিসাব কমিটি কী ব্যবস্থা নিয়েছে ইত্যাদি নিয়ে অনেক অনুসন্ধানী রিপোর্ট করা যায়।
কিন্তু একটা প্রশ্ন বরাবরই সামনে আসে যে, সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার জন্য সংবিধান ও আইন নির্বাচন কমিশনকে যেসব ক্ষমতা দিয়েছে, তারা সেটির কতটা প্রয়োগ করছে বা করতে পারছে? কেননা এই ক্ষমতা প্রয়োগের ওপরেও নির্ভর করে ভোট কতটা অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। রেফারির মতো তারও গলায় বাঁশি এবং পকেটে কার্ড আছে, কিন্তু দেখা গেল সে ফাউল হলেও কার্ড দেখাচ্ছে না বা বাঁশি বাজাচ্ছে না; বরং পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে। অর্থাৎ খেলার মাঠে যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সবার জন্য সমান সুযোগ থাকার কথা—সেটি নিশ্চিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
এ কারণে বলা হয়, একটি নির্বাচন কেমন হবে, তার পুরোটাই নির্ভর করে যে সরকারের অধীনে নির্বাচন হচ্ছে, তাঁরা নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার ব্যাপারে কতটা আন্তরিক, তার ওপর। সেইসঙ্গে নির্বাচনের যারা মূল পক্ষ, অর্থাৎ রাজনৈতিক দল ও প্রার্থী, তাঁদের আচরণের ওপরেও নির্ভর করে ভোটের মাঠের পরিবেশ কেমন থাকবে। তবে গণমাধ্যমের দায়িত্ব হচ্ছে ঘটনা যা, সেটিই লেখা এবং দেখানো। গণমাধ্যম যদি যা ঘটছে, ঘটেছে এবং ঘটার আশঙ্কা রয়েছে, সেগুলো নির্ভয়ে এবং পেশাদারিত্বের সঙ্গে প্রকাশ ও প্রচার করতে পারে, তাহলে সঠিক চিত্র সাধারণ মানুষ জানতে পারে। তখন অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের ওপর একধরনের নৈতিক চাপ সৃষ্টি হয়। গণমাধ্যমের মূল দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে এই নৈতিক চাপে রাখা। আর গণমাধ্যম তখনই অন্যের ওপর নৈতিক চাপ প্রয়োগের অধিকারী হয়, যখন সে নিজের প্রতিষ্ঠানে পেশাদারিত্ব ও সততার চর্চা করে।
লেখক : সাংবাদিক।